গ্যালিলিও থেকে স্কোপসের মাংকিঃ বৈজ্ঞানিক সত্যের পরিণতি!
(১)
বর্তমান সময়ে আমরা যেটাকে বিজ্ঞান বা সায়েন্স বলি সে্টা আদতে একটা সময় পর্যন্ত ন্যাচারাল ফিলোসফি বা প্রাকৃতিক দর্শন হিসাবে পরিচিত ছিল। William Whewell (1834) যারা এই প্রাকৃতিক দর্শনের চর্চাকারী ছিল তাদেরকে সায়েন্টিস্ট বা বিজ্ঞানী হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। বিজ্ঞান আদতে যেইটাকে আমরা ‘ন্যাচারালিস্টিক’ ব্যাপার স্যাপার বলি আরকি সেটার প্রতি আগ্রহী। খুব নগন্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিজ্ঞান আসলে ‘সুপারন্যাচরালিস্টিক’ ব্যাপার স্যাপার নিয়ে খুব একটা বেশি আগ্রহী না। তার মূল কারণটা এই যে, বিজ্ঞান একটা মেথডলজিক্যাল চিন্তা-প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। এই চিন্তাপ্রক্রিয়ার মূল যে জায়গা সেটা হলো প্রশ্ন করা, যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে শেখানো। কিছু দার্শনিকদের মতে বিজ্ঞানের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে সত্যের সন্ধান করা এবং ভুলত্রুটি যথাসম্ভব পরিহার করা। থর্নটনের সাথে চালাচালি করা একটা চিঠিতে আলবার্ট আইনস্টাইন লিখেছিলেন (1),
“….A knowledge of the historic and philosophical background gives that that kind of independence from prejudices of his generation from which most scientists are suffering. This independence created by philosophical insight is-in my opinion-the mark of distinction between a mere artisan or specialist and a real seeker after truth.”
আইনস্টাইনের এই মন্তব্য অনুযায়ী স্পেশালিস্ট আর সত্যান্বেষীর মধ্যে পার্থক্য তৈরিকারী ফ্যাক্টরটা হলো দার্শনিক সূক্ষ্মদৃষ্টি। অর্থাৎ এই যে বিজ্ঞানের সত্যের প্রতি যাত্রাটা আর সত্যের অণ্বেষণের যেই তাড়াটা সেইটা বিজ্ঞানের দর্শনবোধ দ্বারাই চালিত হচ্ছে।
ওয়াটার্লু বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক পল থাগার্ড আবার বলছেন (2),
“But truth is not the only goal of science. The most impressive accomplishments of science are not individual facts or even general laws, but broad theories that explain a great variety of phenomena. For example, in physics the theory of relativity and quantum theory each provide understanding of many phenomena, and in biology the theory of evolution and genetic theory have very broad application. Thus a major part of what scientists strive to do is to generate explanations that tie together many facts that would individually not be very interesting. A scientist who aimed only to accumulate truths and avoid errors would be awash in trivialities. Hence science aims for explanation as well as truth. These two goals subsume the goal of empirical adequacy, because for most scientists the point of describing and predicting observed phenomena is to find out what is true about them and to explain them.”
অর্থাৎ কেবলমাত্র সত্যটাই যে বিজ্ঞান করার উদ্দেশ্য, তাই না। এর বাইরে গিয়ে সেই সত্যকে ব্যাখ্যা করাটাও বিজ্ঞানের কাজ। এখন বৈজ্ঞানিক একটা সত্য তৈরী হয় কীভাবে আসলে?
এই বিষয়টা বুঝতে হলে সায়েন্টিফিক মেথডলজি এবং একইসাথে বিজ্ঞানের দর্শনের দ্বারস্থ না হয়ে আসলে উপায় নেই। সর্বপ্রথমই কোনো বিজ্ঞানী তার আশপাশকার বা চিন্তাজাগতিক কোনো দৃশ্যমান/অদৃশ্য কোনো একটা ঘটনা নিয়ে একটা হাইপোথিসিস প্রদান করেন। তারপর সেই হাইপোথিসিস যদি পূর্ববর্তী বৈজ্ঞানিক সত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, যৌক্তিকভাবে সঠিক মনে হয় তবে সেটা পরিণত হয় থিওরিতে। সেই থিওরি যখন বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট দ্বারা সত্য প্রমাণিত হয় তখন এটাকে আমরা সত্য বলে ধরে নিই। অর্থাৎ একটা দাবিকে বৈজ্ঞানিক সত্যে পরিণত হওয়ার জন্য অনেকগুলো ধাপ পার করে আসতে হয়। এরকম অনেকগুলো থিওরির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ন্যাচারাল ল’।এই ল’গুলো সার্বজনীনভাবেই কাজ করে! এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো কি আমরা তাহলে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নেব তাহলে? এ বিষয়ে আইনস্টাইন বলছেন,
“If you wish to learn from the theoretical physicist anything about the methods which he uses, I would give you the following piece of advice: Don’t listen to his words, examine his achievements. For to the discoverer in that field, the constructions of his imagination appear so necessary and so natural that he is apt to treat them not as the creations of his thoughts but as given realities.” (Einstein 1933, 5–6)
আইনস্টাইন এই যে খারিজ করার কথা বলতেছেন, এইটাই বিজ্ঞান করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বৈজ্ঞানিক সত্যকে তাই আমাদের যে প্রতি অক্ষর ধরে মানতে হবে বিষয়টা এমন না। বরং একটা খারিজি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই সত্যের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হওয়া যায়। র্যাশনাল থিংকিং বা যৌক্তিক চিন্তা আদতে আমাদেরকে এই জিনিসটাই শেখাতে থাকে ক্রমশ।
(২)
Figure: Cartoonist Rollin Kirby depicts fundamentalist education in Tennessee taken to an extreme. Source : Wikipedia |
একদিক থেকে চিন্তা করতে গেলে বিজ্ঞান করাটা নিজে একটা বিপ্লবী কাজ। এই অর্থে বিপ্লবী কাজ যে, বিপ্লব যেভাবে সকল প্রকার এস্টাবলিশমেন্টকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে নতুন একটা শুরুর বার্তা দেয়, ঠিক একইভাবে বিজ্ঞানও বিগত সকল সায়েন্টিফিক এস্টাবলিশমেন্ট থেকে ধরে মানুষের ভেতরকার অনেকদিনের গেঁড়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের এস্টাবলিশমেন্টকে আঘাত করে এবং যৌক্তিকভাবে নতুন একটা শুরুর চেষ্টা করে। চিন্তার এস্টাবলিশমেন্টকে আঘাত করাটা বিপ্লবের শামিল বইকি। আর সেটা যদি হয় বাংলাদেশে, তবে সেটা আরো বেশিভাবেই খাটার কথা! বিজ্ঞানের শিক্ষককে হেনস্তা করা থেকে শুরু করে বিজ্ঞান লেখকদের প্রকাশ্যে খুন করা-সবকিছু বাংলাদেশে খুব সহজেই হয়ে গেছিল, হয়ে যায়। ব্লাসফেমি বা ধর্মনিন্দার জের ধরে বিজ্ঞান লেখকদের/শিক্ষকদের ধর্মীয় র্যাডিকেল গোষ্ঠীর রোষানলে পড়া থেকে শুরু করে নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনাও নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় এইখানে।
বিজ্ঞানের মেথডলজি আর বিশ্বাস দুইটা সবসময় এক ধারায় চলতে পারে না। যে সঠিকভাবে বিজ্ঞান করতে চাইবে তাকে বিজ্ঞানের এই যে ফিলোসফি, প্রশ্ন করার সিলসিলা এইটাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অনেক পুরোনো ধ্যান ধারণা, পূর্ববর্তী জ্ঞান এই প্রশ্নের সিলসিলায় বাতিল হয়ে যাবে, এখান থেকে একটা নতুন ধরনের জ্ঞানের উৎপাদন এবং পুনরোতপাদন হবে। সেই জ্ঞান সবসময়ই এস্টাবলিশমেন্টের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতীয়মান হবে, এবং সেটা কখনোই কোনো কর্তৃত্ববাদী সমাজ খুব ভালোভাবে নিতে পারার কথা না। যুগে যুগে তাই সক্রেতিস আর গ্যালিলিওদের বারবার জন্ম নিতে হয়, আরেকবার মরতে হবে বলে। এই অর্থেও বিজ্ঞান একটা বিপ্লবী চিন্তা যে, বিজ্ঞান করতে হলে নিজেকেও খারিজ করতে হয়- নিজের বোঝাপড়া, বিশ্বাস এমনকি যুক্তি যে সময়ে অকেজো প্রমাণিত হয়ে যায়, ঠিক সে সময়েই নিজেকে খারিজ করে নতুন জ্ঞান, বোঝাপড়ার দিকে এগুতে হয়। একটা প্রচলিত টার্ম আছে এই বিষয়টার, ‘সায়েন্টিফিক টেম্পারমেন্ট’। প্রত্যেকটা স্বতন্ত্র মানুষের কোনো একটা সমস্যার দিকে লজিক্যালি আর র্যাশনালি এগুনোর এই যে প্রক্রিয়া সেইটাই এই সায়েন্টিফিক টেম্পারমেন্ট। এই সায়েন্টিফিক টেম্পারমেন্ট যে কেবলমাত্র বিজ্ঞান করার কাজেই লাগবে বিষয়টা এমনও না। নিত্য-নৈমিত্তিক সকল কাজের প্রতি আমাদের এগুনোর যে প্রক্রিয়া সেটা এই টেম্পারমেন্ট দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
(৩)
একটা ঘটনার স্মরণ আমরা করতে পারি আসলে। টেনেসির বিখ্যাত একটা ট্রায়াল আছে, মাংকি ট্রায়াল নামে। স্কোপস ট্রায়াল নামেও পরিচিত এই ট্রায়ালটি। ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত এই ট্রায়ালটি চলে। এই মামলাটি যার বিরুদ্ধে লড়া হয় তিনি টেনেসির একটা হাই স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন, জন স্কোপস! টেনেসির বিখ্যাত(!) বাটলার আইনে স্কোপসের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। এই বাটলার আইনটি ছিল এরকম যে পাব্লিক কোনো স্কুলের শিক্ষকরা মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে বাইবেলের ধারণার বাইরে যেতে পারবে না। এমনকি বিবর্তন সংক্রান্ত সকল ধারণা বাইবেলের পরিপন্থী দেখে ক্লাসরুমে এই ধরনের কোনোকিছু পড়ানো যাবে না, যদি পড়ানো হয় তবে ব্লাসফেমির জন্য ঐ শিক্ষককে কারাগারে পচতে হবে। আগেই যেটা বলছিলাম, বিজ্ঞান তার মতো করেই প্রতিটা ধাপে প্রশ্ন করতে করতে এগিয়ে যাওয়ার কথা। সেখানে যতবারই এস্টাবলিশমেন্ট বিব্রত হবে ততোবার বাটলার আইনের মতোন আইন করে জন স্কোপসের মতোন শিক্ষকদের জেলে পুরার পায়তারা চলতে থাকবে। ঐ যাত্রায় স্কোপস অবশ্য ১০০ ডলার জরিমানা দিয়ে রক্ষে পেয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু জরিমানার পরিমাণ যাই হোক না কেন ঐ মামলায় স্কোপস দোষী সাব্যস্তই হয়েছিলেন। এইখানেই মূল সমস্যাটি জাগে। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি যুক্তি দিয়ে যুক্তিকে খন্ডন করছেন ততক্ষণ সেটা একটা সুস্থ স্বাভাবিক সমাজের পরিচায়ক হয়। কিন্তু এই যে চিন্তার বিরুদ্ধে, কথার বিরুদ্ধে মামলা-হামলা-খুন করে ফেলার বিষয়টা খুবই বর্বর একটা আচরণ। জ্ঞানচর্চার সর্বপ্রথম শর্ত হচ্ছে সীমাহীন স্বাধীনতা। কেননা জ্ঞানের উৎপাদনের সাথে ভুল করার একটা গভীর সম্পর্ক আছে, সম্পর্ক আছে সবচেয়ে বিব্রতকর প্রশ্নটা করার। এখন জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা যদি নাই থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো ফরমায়েশী।
স্কোপস ট্রায়ালের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী সময়ে। পুরো পৃথিবীজুড়েই। আমেরিকান খ্রিস্টানরা একদিকে সত্য খোঁজার দুটো রাস্তা পেল, একটা বাইবেলীয় সত্য আর অন্যটা বিবর্তনবাদ থেকে পাওয়া সত্য। অন্যদিকে প্রকাশ্যে গোঁড়ামির প্রতিবাদ করার শাস্তির চল শুরু হয় অনেক জায়গাতেই। বিবর্তন বিরোধী মোর্চা থেকে শুরু করে আন্দোলন সবকিছু হয় ডানপন্থীদের হাত ধরে। এই সবকিছুর পাশাপাশি অন্য যে বড় আর ভয়াবহ প্রভাবটা পড়ে সেটা হলো বিজ্ঞান শিক্ষা আসলে কীভাবে হবে সেই জায়গাটিতে। প্রকাশ্যে বিবর্তন নিয়ে কথা বলাটা যেখানে অপরাধে পরিণত হয়ে যায়, সেখানে আর যা কিছু হোক বিজ্ঞান তো আর পড়ানো সম্ভব না। বিজ্ঞানের যুক্তি আর যৌক্তিক প্রক্রিয়া রোষানলে পড়ে কোর্ট-কাছারির। বিজ্ঞান শিক্ষা বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা বলে, আর এই সত্য প্রমাণহীন কোনো সত্য না। ভয়াবহ বিষয়টা হচ্ছে এই সত্য বলতে গিয়ে স্কোপসের মতোন হাজারো শিক্ষককে বিপদে পড়তে হয়েছে। স্কোপস ট্রায়ালের আগেও, স্কোপস ট্রায়ালের পরও। সমসাময়িক বাংলাদেশ স্কোপসের সেই শাস্তির কথাই বারবার মনে করিয়ে দেয়। বৈজ্ঞানিক সত্য ক্লাসরুমে বলার সময় কিংবা বৈজ্ঞানিক সত্য লিখে প্রকাশ করার জন্য এই দেশেই প্রচুর নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে।
১৬৩৩ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি যখন বলেন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তখন থেকেই চার্চ আর বিজ্ঞানের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব শুরু হয়। গ্যালিলিওকে পাঠানো হয় কারাগারে। ঠিক সেই সময়টা থেকে ধরে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান যতবার প্রচলিত ধারণাকে যুক্তি দিয়ে আঘাত করেছে, ততবারই খড়্গ নেমে এসেছে বিজ্ঞানীদের উপরে। যে সায়েন্টিফিক টেম্পারমেন্টের কথা বলছিলাম আগেই, সায়েন্টিফিক টেম্পারমেন্টের কারণে আসলে বিজ্ঞানীও হতে হয় না, সাধারণ যে কোনো মানুষ প্রশ্ন করতে শিখলেই তার মধ্যে যুক্তির সঞ্চার হতে থাকে। সেই যুক্তিবোধ থেকেই আমেরিকার টেনেসির বিজ্ঞান শিক্ষক বাটলার আইনের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বিবর্তন পড়িয়েছেন ক্লাসরুমে। সেই যুক্তিবোধের কারণেই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত কোনো এক অঞ্চলের কোনো এক বিজ্ঞান শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের যুক্তি শেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আফসোসের বিষয়টা হচ্ছে সে যুক্তির ধার কেউ ধারে না। তাই প্রত্যেকটা যুগেই নতুন করে গ্যালিলিও-সক্রেতিসরা জন্মে যাচ্ছেন, আরেকবার মরবেন বলে। আর এই মরণের লুপ ততোদিন থামবে না, যতোদিন ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র যুক্তির স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, সত্যের স্বাধীনতাকে স্বীকার করবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সে পথ অনেক দূরে। তবুও আশা রেখে লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে- এই হচ্ছে মোদ্দাকথা!
তথ্যসূত্রঃ
1. Einstein to Thornton, 7 December 1944, EA 61–574
2. Thagard, P. (2004). Rationality and science. In A.Mele & P. Rawlings (Eds.), Handbook of rationality. Oxford: Oxford University Press, (pp. 363-379).
Comments
Post a Comment