সাম্প্রতিক ক্যাম্পাস ও কিছু ভাবনা
বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্তচিন্তা,মুক্তবুদ্ধির চর্চার একটা জায়গা। অর্থাৎ এখানে সব ধরণের জ্ঞানের আদান প্রদান হবে।এখানে শিক্ষক ছাত্র সম্পর্ক থাকবে উদার। এখন দেখা যাচ্ছে মুক্তচিন্তা বা মুক্তবুদ্ধির চর্চা যা ই বলি না কেন এটা আমাদের মধ্যে হয়ে উঠছে না।এ হয়ে না উঠাটার একটা বিরাট প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি আমাদের আশপাশের জীবনে। নিরাপত্তাহীনতা তার মধ্যেই একটি।আজকে বেশ কিছু সমস্যা আর আমার চোখে তাদের সমাধান কেমন হওয়া উচিৎ তা লিখব । প্রথমেই বলে দিয়েছি এসব সমাধান আমার চোখে, অতএব এগুলো বেদবাক্য নয়,বরং খন্ডনযোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের
মনোভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক একটা জায়গা এখানে। কারণ এই সকল সমস্যা
সমাধানে সবাইকেই একযোগে কাজ করে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে
নির্দিষ্ট বলয়গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে অবশ্যই। চিন্তাচেতনার জায়গাটা অত্যন্ত
পরিষ্কার হওয়া দরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। একজন সুচিন্তক একটা সমস্যার
আদ্যোপান্ত মূল জায়গা থেকে বিশ্লেষণ করতে পারেন। তাই এই সমস্যার সমাধানটাও
বাস্তবসম্মত ও কার্যকরি হয়ে উঠে। আমাদেরকে প্রথমেই এই চিন্তার জায়গাটা তৈরী করতে
হবে।এবং খেয়াল করে দেখবেন এই চিন্তার জায়গা তৈরীর সাথে জ্ঞানের আদান-প্রদানের একটা
নিবিড় সম্পর্ক আছে।অতএব, আমাদের জ্ঞানের আদান-প্রদানের জায়গা থাকতে হবে।
ক্যাম্পাসে আড্ডার জায়গা থাকতে হবে, পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ থাকতে হবে।থাকতে
হবে থাকবে হবে বলে দায় এড়িয়ে নেয়া যায় না আসলে। এই জায়গাটি আমাদের নিজেদেরই তৈরী
করতে হবে। আমাদের প্রচুর পরিমাণে আড্ডার জায়গা দরকার। আড্ডা যে একটা আইডিয়া বা ধারণা তৈরীতে কতটা ভূমিকা পালন
করতে পারে ফরাসি বিপ্লব তারই একটা উদাহরণ। মোদ্দাকথা একটাই ক্যাম্পাসে আড্ডার
আয়োজন নিয়মিত হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা কেমন
হওয়া উচিৎ কিংবা নিরাপত্তা বেষ্টনী কেমন থাকা উচিৎ এ নিয়ে বলতে গেলে অনেক কিছুই
বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের পক্ষে অনেককেই কথা বলতে
শুনেছি। খুবই যৌক্তিক একটা কথা। কিন্তু এর পরেও একটা কিন্তু খেলা করে।
বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে উদার। আর পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়।
জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা নিয়ে একটা প্রশ্ন তো রয়েই যায়।তবুও আমি সীমানাপ্রাচীর
নির্মাণটিকে একটা সমাধান হিসেবে যদি দেখিও সেক্ষেত্রে আরো কিছু প্রশ্ন দাঁড়ায় ।
সীমানা প্রাচীর নির্মাণের পর ও ক্যাম্পাস নিরাপদ তো? এই বিষয়টি নিয়ে আমার
ব্যক্তিগত মতামত হলো সীমানাপ্রাচীরের মাধ্যমে ক্যাম্পাস নিরাপদ রাখা তখনই সম্ভব
যখন ক্যাম্পাসটা উতসবমুখর এবং ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবে। ক্যাম্পাসে
গত কয়েকবছরে নিরাপত্তাহীনতার মোটামুটি সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে সকল ঘটনা
জনমানবহীন স্থানে ঘটেছে। ক্যাম্পাস সরগরম রাখার ক্ষেত্রে পূর্বোল্লিখিত আড্ডা যে
ভূমিকা রাখতে পারে তাতে কোন সন্দেহ
নেই।অতএব আড্ডা জিনিসটা আমাদের ক্ষেত্রে এক ঢিলে দুই পাখি ধরণের। প্রথমত
একটা চিন্তাচেতনার জায়গা তৈরী করবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ,আর দ্বিতীয়ত ক্যাম্পাসটাকে
সরগরম রাখবে,এতে করে অপরাধী অপরাধ করার সাহস পাবে না।
এরপরের বিষয়টি একটি
গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। অন্যান্য সন্ত্রাসবাদ এবং মৌলবাদ বা জঙ্গীবাদ কিভাবে বিস্তার
লাভ করছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। মৌলবাদ আর জঙ্গীবাদের বীজ বপিত হয়েছে হেজেমনির
মাধ্যমেই। এই সন্ত্রাসীরা একটা আইডিয়া বা ধারণা দ্বারা হেজেমনি বা আধিপত্যের শিকার
হচ্ছে।অতএব খুবই মৌলিক জায়গা থেকে এর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই হেজেমনির একটা
কাউন্টার হেজেমনি দাঁড় করাতে হবে।কাউন্টার হেজেমনি প্রচলিত অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ
মূল পয়েন্টটি হলো এই সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে আমাদের একটা উদার দর্শন ছড়িয়ে দিতে হবে ,এবং
সর্বপ্রথম এই দর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থীদের মধ্যে পৌছে দিতে হবে।এই
জিনিসটা অবশ্যই শিক্ষদের কর্তব্য। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা এক্ষেত্রে ত্রাণকর্তা।অতএব
তাঁদের সাথে আমাদের যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে সে দুরত্ব অতিদ্রুত কমাতে হবে। এবং
শিক্ষকদের ও এগিয়ে আসতে হবে এই সকল বিষয়ে। তাহলেই পারস্পরিকভাবে এই সন্ত্রাসবাদকে
মূল থেকে উৎখাতের একটা সম্ভাবনা তৈরী হবে।
এসবের বাইরেও কিছু প্রায়োগিক
দিক আছে।সেসব প্রায়োগিক দিক নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।প্রথমেই বলা যাক ,ক্যাম্পাসের ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসটা রাতের বেলা সম্পূর্ণ আলোকিত থাকা খুবই প্রয়োজন। এই আলোকিত থাকা জিনিসটার মধ্যে
একটা মনস্তত্ত্ব কাজ করে। আলোতে সাধারণত অপরাধকর্ম কম সংঘটিত হয়।পাশাপাশি
ক্যাম্পাসের যেসকল ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাগুলো আছে তার স্বয়ংক্রিয়তা ও সঠিক
তত্ত্বাবধান করা দরকার। অপরাধী যাতে অন্তত পালিয়ে বাঁচতে না পারে এজন্যই এই বিষয়টি
প্রয়োজন। টংগুলো রাতের বেলা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ,(হোক সেটা ১০ টা) খোলা
থাকা উচিৎ। চায়ের কাপের আড্ডায় কত গুরুত্বপুর্ণ বিষয় উঠে আসে এটা বোধ করি নতুন করে
বলার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া বিভিন্নজনের মতামতের প্রেক্ষিতে সার্বক্ষণিক লাইব্রেরী
খোলা রাখার একটা প্রস্তাব করা হয়েছিল।প্রস্তাবটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি
প্রস্তাব। অন্ততপক্ষে সপ্তাহে সাতদিন রাত এগারোটা পর্যন্ত লাইব্রেরী খোলা রাখার
প্রস্তাব এসেছে।প্রস্তাবটিকে সাধুবাদ জানাই।কারণ এই প্রস্তাবটা শিকল ভাঙার মতো
একটা প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের সুবিধাগুলো নানা আঙ্গিক থেকে ব্যাখ্যা করা
যায়।প্রথমত ,শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরীমুখীতা বাড়বে এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়াও দেখা যায় যে
অনেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত ক্লাস করার পর ক্লান্তিবোধের কারণে এরপর লাইব্রেরীতে
যেতে পারে না,টিউশন অন্যান্য কারণে সারাসপ্তাহ ব্যস্ত থাকে,আর বন্ধের দিনগুলো
একরকম ঘরে বসে কাটাতে হয়।এই বিরক্তি থেকে মুক্তি কিংবা ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও
লাইব্রেরী ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত হবে এই রাত ১১ টা পর্যন্ত লাইব্রেরী খোলা
থাকলে।
এর পাশাপাশি অবশ্যই আমাদের
সাংগঠনিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।বিভিন্ন সাংস্কৃতিক,বিজ্ঞান বা স্বেচ্ছাসেবী
সংগঠনগুলোর কার্যক্রম আরো ব্যাপক পরিমাণে বাড়াতে হবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় হলো সংগঠনগুলোকে আদর্শিক জায়গা থেকে পরিষ্কার থেকে যথাসম্ভব কাজ করে যেতে
হবে। সাধারণ শিক্ষার্থী আর সংগঠনকর্মীর মধ্যে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে বা হচ্ছে তা
থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে। সংস্কৃতিকর্মীর হাতে সমাজ পরিবর্তনের অনেক সুযোগ
থাকে।একটা আদর্শিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটা সমাজের পরিবর্তন আনতে পারে। অতএব
ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক সংঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।ক্যাম্পাসে এই চর্চা অব্যাহত
থাকলে ক্যাম্পাসের ভেতরের মানুষদের মধ্যে থেকে সংকীর্ণতা দূর করা সম্ভব বলে আমি
মনে করি।
সর্বোপরি , সাধারণ
শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা গণসচেতনতা তৈরী করা অত্যন্ত দরকার।সেই গণসচেতনতা বই
পড়িয়ে হোক, গান শুনিয়ে হোক,নাটক দেখিয়ে হোক আর অন্যান্য শিল্পের মাধ্যমেই হোক তৈরী
করতে হবে। আর এই গণসচেতনতা যদি তৈরী সম্ভব হয় প্রত্যেকেই নিজেদের দায়িত্ব ,কর্তব্য
এবং অধিকারগুলো সম্পর্কে বুঝতে পারবে,তখন তাঁরা আর কাঠের পুতুল হয়ে থাকবে না,তাদের
উপর যা খুশি তা চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হবে না। এই গণসচেতনতা আসুক,ক্যাম্পাসে
নিরাপত্তাহীনতা কেন কোনো ধরণের কোনো ছোটোখাটো অন্যায়ের ঘটনাও সহজে ঘটবে না এটা জোর
গলায় বলা যায়।মুক্তচিন্তা মুক্তি পাক,সংকীর্ণতা নিপাত যাক।
Comments
Post a Comment