জামাল নজরুল ইসলামঃ গভীর জীবনবোধের শিল্পী


মহাবিশ্বের অধ্যয়ন মোটা দাগে অনন্য এক অভিজ্ঞতা। অন্তত: এক দিক থেকে এটা সামগ্রিকতাকে বোঝার একটা প্রয়াস। আমরা, চিন্তাশীল সত্ত্বার অধিকারীরা নিউট্রন তারকা আর শ্বেত বামনদের নিয়ে গঠিত এই মহাবিশ্বের অংশ, এবং আমাদের গন্তব্য অনুদ্ধরণীয়ভাবে এই মহাবিশ্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
                 -----------দা আল্টিমেট ফেইট অব দা ইউনিভার্স।



অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে বলতে গেলে অনেক কিছুই বলা যায়। তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক সকল কাজ, মহাবিশ্বের পরিণতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা কিংবা আরো অনেক কিছুই।তবে আজকে সেসব কিছু নয় বরং বিজ্ঞানের বাইরের অন্য এক জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে বলার ইচ্ছা আছে। একজন বিজ্ঞানী মাত্রই একজন দার্শনিক।জামাল নজরুল ইসলাম ও তেমনি। তবুও কেন জানি তিনি অন্য অনেককে ছাড়িয়ে গেছেন জীবন সম্পর্কে গভীর বোধ ,মানবতা সম্পর্কে তাঁর গভীর ভাবনা দিয়ে। বিজ্ঞান ও দর্শন একে অপরের পরিপূরক। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের একটা উক্তি আছে যেটাকে বাংলা করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায়,

“ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দর্শন ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ,যতটা পাখিদের কাছে পক্ষীতত্ত্ববিদ্যা”

বিজ্ঞানের সাথে দর্শনের আছে গভীর সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন কোনো সম্পর্ক নয়,সে সম্পর্ক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠা এক সম্পর্ক।লিখছিলাম প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে।সত্যিকার অর্থে এই লিখা লিখবার দুঃসাহস করার জন্য প্রথমেই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। তিনি সারাজীবন এই দর্শনের চর্চা করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনকে সত্যিকার অর্থেই ধারণ করেছিলেন এই বিজ্ঞানী। ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিরাট ভক্ত। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রসঙ্গ টেনে আনতেন। তুলে আনতেন সমাজের গরীব দুঃখী ,নিঃস্বের কথা। এই বিজ্ঞানী নিভৃতচারী ছিলেন। নিজেকে দূরে রেখেছিলেন মিডিয়ার সামনে থেকে। শুরু করি শুরু থেকেই। জামাল নজরুল ইসলাম নামটা শুনলেই নামের মিলের কারণে সর্বপ্রথম যে মানুষের নাম আমাদের মনে পড়ে তাহলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই নামের মিলের পেছনেও কারণ আছে। অধ্যাপক ইসলামের বাবা-মা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের ভক্ত। অধ্যাপক ইসলাম নিজেও ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুরাগী। শুধু অনুরাগী নয়,নজরুল সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান যেকোনো ব্যক্তি থেকেই অনেক বেশি। একই কথা খাটে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও। তিনি নিজেও ছিলেন সাহিত্যচর্চার সাথে যুক্ত।এর কিছু প্রকাশ পেয়েছে, কিছু প্রকাশ পায় নি।তাঁর জীবনের কিছু ছোটোগল্প নিয়ে,কিছু শব্দ ,কিছু রঙ নিয়ে আজকের এই লিখা। অধ্যাপক ইসলাম একবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে দুটি ছেলেকে বাঁশি বিক্রয় করতে দেখেন।সেই বাঁশি ওয়ালা দুইজনকে ডেকে তিনি একহাজার টাকা দিয়ে দুটি বাঁশি কিনলেন। এই বাঁশি কেনার পেছনে তাঁর অভিমত হলো,

সমাজ থেকে বাঁশি হারিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই ওদের নিকট থেকে বেশি দামে বাঁশি কিনছি,যাতে ওরা বাঁশি বিক্রিতে উৎসাহ পায় আর বাঁশি বাজাতেও।

 অধ্যাপক ইসলাম নিজে ছিলেন সুফীতত্ত্বে বিশ্বাসী। তিনি এই সূফীতত্ত্বের ব্যাখ্যা করতেও পছন্দ করতেন। তাঁরই কথা অনুযায়ী আড়াই হাজার বছর আগে কনফুসিয়াস বলেছিলেন ,সমগ্র মানবজাতি একটা পরিবারের মতো। প্রায় একই সময়ে গৌতম বুদ্ধ ও অনুরূপ মনোভাব পোষণ করেন। অধ্যাপক ইসলামের সুচিন্তার প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রচিত দুইটি বাংলা বই “মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ” এবং “শিল্প ,সাহিত্য ও সমাজ” এ। একজন বিজ্ঞানী যিনি ব্যস্ত থাকতেন সারাটাদিন গবেষণার কামরায়।সারাদিন মাথায় জটিল জটিল সমীকরণ ঘুরত যার মাথায় ,সেই তাঁর পক্ষে এমন সুন্দর দুটি বই রচনাটা সাধারণের চোখে দেখলে একরকম অসম্ভবই মনে হয়।কিন্তু না।অধ্যাপক ইসলাম যতটা বিজ্ঞানের ছিলেন,ঠিক ততটাই ছিলেন শিল্পের। সকল প্রকারের শিল্পকর্মের প্রতি ছিল তাঁর আলাদা মোহ। অধ্যাপক ইসলামের উপরোক্ত দুইটি বই থেকে অনেক উদ্ধৃতি এই লিখায় ব্যবহার করব ।
অধ্যাপক ইসলামের কাছে যখন কোনো ছোটো বাচ্চা আসতো তিনি তাদেরকে পিপীলিকা,টুনটুনি ও অন্যান্য পশুপাখিদের নিয়ে ছড়া লিখে দিতেন।প্রবল হাস্যরসবোধ ছিল অধ্যাপক ইসলামের মধ্যে।যেমন ছিল হাস্যরসবোধ তেমনি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস।ছিলেন সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে।সুযোগ পেলেই আবৃত্তি করে উঠতেন রবীন্দ্রনাথের “দুই বিঘা জমি”

“শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন ,বুঝেছ উপেন, এ জমি লইব কিনে।
কহিলাম আমি,তুমি ভূস্বামী,ভূমির অন্ত নাই।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাই। “

অধ্যাপক ইসলাম ছিলেন ভূস্বামীর এই শোষণের বিরুদ্ধে। ছিলেন বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বিরুদ্ধে। তাঁকে দেখা গেছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করতে। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী একজন মানুষ। ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর সকল প্রকার ঋণের বিরুদ্ধে।বলে গিয়েছেন,

“ সব ধরণের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের প্রচুর সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ ,প্রাকৃতিক সম্পদ ও বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য আছে যার সুষথু ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা নিজেরাই নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারি। কিন্তু আমরা বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেই উন্নয়নের দিকে যেতে পারছি না। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই,আমাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের উপর নির্ভরতা।“
         -মাসিক বিশদ সংবাদ (আগস্ট ২০০৭)

টেনে এনেছেন নজরুলকে,

 “ নজরুল  দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অনেক আগেই বলেছেন,যাকে আমি আমাদের স্বাধীনতার প্রথম ও প্রকৃত ঘোষণা বলে থাকি। ধুমকেতুতে তিনিই প্রথম বলেছিলেন।বিদেশী ভজনার স্বভাব ত্যাগ করে লড়াই-আন্দোলনের মাধ্যমে বিদেশীদেরকে বিতাড়িত করে দেশের ভাগ্য নির্ধারণের চাবিকাঠি নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে সম্পূর্ণভাবে।আজকের প্রসঙ্গে সেই চেতনাটাই সবচেয়ে জরুরি।“
         ---পূর্বোক্ত।


উপরের দুটি উক্তিকে পর্যালোচনা করলে যে কেউই খোলাচোখে এ সত্যটি ধরে ফেলতে সক্ষম হবেন যে অধ্যাপক ইসলাম রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ছিলেন এবং ছিলেন এসব বিষয়ে সুচিন্তক।শুধু এই দুটি নয় অর্থনীতি বলুন আর পরিবেশ বলুন আর নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জীবন বলুন সব বিষয়ে তিনি তাঁর জীবনবোধের আর মানবিকবোধের পরিচয় দেখিয়েছেন। মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ  এই গ্রন্থটিতে তিনি বলেছেন আমাদের পরিবেশ আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার কথা চিন্তা না করে বরং আমাদের ভাবতে হবে ,ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে আমরা ধার নিয়েছি;আমাদের জীবনকালে এর যেন অবনতি না ঘটে। “শিল্প,সাহিত্য ও সমাজ” এই গ্রন্থটিতে তিনি লিখেছেন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিদের পক্ষে। যখন পার্বত্য চট্টগ্রামে শত কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা ও অন্যান্য নির্মাণের প্রস্তাবনা উঠে তখন তিনি এর প্রচন্ড সমালোচনা করেন। উদ্বিগ্ন হোন পাহাড়িদের জীবন নিয়ে। বেশ কয়েক বছর আগের পত্রিকা ঘাটলে খুঁজে পাবেন রোহিংগাদের শরনার্থী হিসেবে এদেশে আনার ব্যাপারেও তিনি কথা বলেছেন। আজকে এই সময়ে এসে ঠিকই আমরা সবাইই এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়েছি।
বিজ্ঞান,দর্শন,ধর্ম ও আইডিওলজি  প্রবন্ধের শেষে তিনি লিখেছেন,

 “ আমি কতকগুলি উদ্ধৃতি দিয়ে এই প্রবন্ধটি শেষ করতে চাই,যেগুলি বিজ্ঞানের শান্ত,নম্র ও চিন্তাশীল দিকগুলি ব্যাখ্যা করে এবং যেগুলো মানবজাতির সত্যের ও জ্ঞানের সন্ধান ও চর্চার প্রতীকস্বরূপ দেখা যায়।আমি এই দিকটিকে প্রযুক্তি ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানের চেয়ে কোনো অনবগশে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনা। এবং এর বিরাট সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক দিকের গুরুত্ব রয়েছে। একই কারণে আমাদের চারুকলা ও ও শিল্পকলার সব ধরণের কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন,কারণ এগুলি মানুষের অদম্য সত্তার গভীরতম বহিঃপ্রকাশের মধ্যে গণ্য”


এরপর তিনি যে উক্তিগুলো তুলে ধরেন তার কিছু আমি লিখছি,
  পদার্থবিজ্ঞানী  স্টিফেন ওয়াইন্সবার্গ  এর উদ্ধৃতি,

“ মহাবিশ্বকে বুঝবার প্রচেষ্টা সেই কতিপয় জিনিসের মধ্যে গণ্য যেগুলি মানবজীবনকে একটি প্রহসনের পর্যায় থেকে একটু উঁচুতে নিয়ে গিয়ে কিছুটা ট্রাজেডির মর্যাদা দেয়”

আল্লামা ইকবালের উদ্ধৃতি,

“ আছে ও ছিলর বাগানকে তুমি উদাসীন চোখে দেখো না,এটা দেখবার জিনিস,বারবার চেয়ে দেখো”

রবীন্দ্রনাথের মনোভাব,

“ মহাবিশ্বে,মহাকাশে ,মহাকাল মাঝে,
 আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে”

উক্তিগুলো বা অধ্যাপক ইসলামের আলোচনা  দেখলে বোঝা যায় তিনি দর্শনচর্চায় কতটা মগ্ন থাকতেন। অধ্যাপক ইসলাম এমনই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান অনেক অর্থনীতিবিকে ঈর্ষান্বিত ও করেছে হয়তবা।সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর পারদর্শিতা হয়ত মুগ্ধ করেছে অনেক সঙ্গীতজ্ঞকে। তিনি নিজে সঙ্গীতের চর্চা করতেন।খুব সুন্দর সেতার বাজাতে পারতেন।বাজাতে পারতেন পিয়ানোও। তাছাড়াও ছিলেন একজন কণ্ঠশিল্পী।ধ্রুপদী সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর যে জ্ঞান ছিল তা বোধ হয় আজকালকার অনেক বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞের ও নেই। ছিলেন অসাধারণ এক চিত্রশিল্পী। সুযোগ পেলেই ছবি আঁকতেন। সংগীত বিষয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধ ও আছে, “উপমহাদেশ এবং পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত” এই শিরোনামের। গণিত সাধনার সাথে তিনি সঙ্গীত সাধনার মিল খুঁজে পেয়েছেন,

  “ যারা অভিজ্ঞ ও সমঝদার শ্রোতা তাঁদের জন্য পরিবেশনায় শ্রুতির সূক্ষ্ম ও দক্ষ ব্যবহার সৌন্দর্যের সৃষ্টি করবে,তবে সেটা হবে কিছুটা তেমন সৌন্দর্য যা একজন গণিতবিদ একটি গাণিতিক উপপাদ্যে দেখেন”
    --শিল্প ,সাহিত্য ও সমাজ।



পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিল্পকলার প্রতি তাঁর আগ্রহের কথা । ইতালিতে বসে একেছিলেন জীবনের শেষ ছবিটি ১৯৯১ সালে। এই ছবিগুলো শোভা পাচ্ছে তাঁরই বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর গবেষণাকেন্দ্রের সামনে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর প্রতিকৃতি প্রমাণ করে শিল্প সম্পর্কে তাঁর ভালোলাগাটা কতটা গভীর।অধ্যাপক ইসলাম বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার পক্ষে জোরালো দাবী ও যুক্তি উপস্থাপন করে গিয়েছেন। জগদীশচন্দ্র বসু বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা জনপ্রিয় করার কথা তুলেন সর্বপ্রথম,এরপরে সত্যেন্দ্রনাথ বসুও একই যুক্তি প্রদান করেন।অধ্যাপক ইসলাম তাঁদেরই যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলেই এ বিষয়টি বোঝা সম্ভব। একটা সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন ,তত্ত্বীয় ও মৌলিক বিজ্ঞানের মান উন্নয়নের জন্য সর্বস্তরে বিজ্ঞান চর্চা প্রয়োজন। আর এই বিজ্ঞান চর্চা হতে হবে মাতৃভাষায়। তাছাড়াও তিনি আরো একটা কথা বলতেন,সেটা হলো সবাইকে যে বিজ্ঞানী হতে হবে এমন না।কিন্তু সবারই ন্যূনতম একটা বিজ্ঞানশিক্ষা থাকা উচিৎ। সত্যিকার অর্থেই তা। কারণ ,সমাজের যেসকল কুসংস্কার আদতে টিকে আছে সেসকল কুসংস্কার টিকে থাকার পেছনে বিজ্ঞানশিক্ষার অভাব একটা মূল কারণ। অতএব সার্বজনীন একটা বিজ্ঞান শিক্ষা যদি সকল মানুষের মধ্যেই পৌছে দেয়া যায় তাহলে হয়তবা এসকল কুসংস্কার দূর করা সম্ভব। অধ্যাপক ইসলাম যেমনি কথা বলে গেছেন মাতৃভাষার পক্ষে ,তেমনিই বলে গেছেন কৃষির পক্ষে।কৃষিতে তিনি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে দেখেছেন। আবার শিল্পের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন এভাবে,

   “শিল্পায়নের প্রসঙ্গে আমার সাফ কথা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ,এডিবি আই এম এফ এর ক্ষতিকারক প্রেসক্রিপশন বাদ দিয়ে নিজেদের প্রেক্ষাপটে ও প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি সুষ্ঠু শিল্পনীতি আমাদের প্রণয়ন করতে হবে”

তিনি যেমন সমালোচনা করে গেছেন বিশ্বব্যাংক আই এম এফকে তেমনিভাবে সমালোচনা করে গেছেন শিক্ষার নামে বেনিয়াবৃত্তি চালানো লোকজনদের। ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যবসায়িক একটা লাভের দিক থেকে থাকছে বলে এই মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা আমাদের সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা পোষণ করতে পারছে না,তাদের মধ্যে একটা সংস্কৃতিবিমুখ মনোভাব কাজ করছে বলেও তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন। অধ্যাপক ইসলাম ছিলেন একজন প্রকৃত জ্ঞানপিপাসু।সর্ববিষয়ে তাঁর জ্ঞান অর্জনের একটা চেষ্টা সবসময়ই লক্ষ্যণীয়। অধ্যাপক ইসলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও বিরাট অবদান রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরীতে তিনি যেমন অবদান রেখেছিলেন অন্যদিকে ব্রিটেন সরকারসহ অন্যান্য বিভিন্ন দেশের উচ্চপদীয় ব্যক্তিদের চিঠির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের দিকে তাঁদের দৃষ্টি আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অধ্যাপক ইসলামের দেশে ফিরে আসাটাকে অনেকেই মহানুভবতা হিসেবে দেখেন।কিন্তু তিনি নিজে কখনো তা মনে করতেন না। তিনি বলতেন বরং না ফিরে আসাটাই ছিলো অস্বাভাবিক। তাঁর দেশে ফিরে আসা সম্পর্কে এক সাক্ষাতকারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন স্থায়ীভাবে বাইরে থাকার কোনো পরিকল্পনা তাঁর মধ্যে কখনোই ছিল না।কারণ দিনশেষে আপন মানুষের ভালোবাসা কখনোই বাইরে থেকে অনুভব করা যায় না। অধ্যাপক ইসলামের গুণের কথা লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখা যাবে। তাঁর কর্ম ও জীবন এতটা বিস্তৃত ছিল। নিভৃতচারী একজন মানুষ যিনি আড়ালে রেখেছিলেন নিজেকে সব মিডিয়া থেকে। অথচ এই মানুষটার যে অসীম জীবনবোধ তা বোধ হয় আজকালকার সময়ে খুঁজে পাওয়া বড় দুষ্কর। বিজ্ঞানীরা অগোছালো হবেন এটা স্বাভাবিক একটা নিয়মের মধ্যে পড়ে হয়তো। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী আরশাদ মোমেন ,পদার্থবিজ্ঞানী অজয় রায় এসব মানুষের জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা দেখলেই তা ধরা পড়ে। কিন্তু পরিবারকে তিনি কখনোই অবহেলা করেন নি।প্রচন্ড ভালোবেসেছেন স্ত্রী সুরাইয়া ইসলামকে,দুই মেয়েকে। এখানে কিছু জিনিস উল্লেখ করা আবশ্যিক মনে করছি। অধ্যাপক ইসলাম যে আজকের জামাল নজরুল ইসলাম হয়ে উঠতে পেরেছেন তার পিছনে তাঁর পরিবারের মানুষজনের অনেক অবদান আছে।তাঁর পিতা শৈশবেই তাঁকে গণিত ও সংগীত বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করেন।আর মা থেকে তিনি পেয়েছেন সাহিত্যের নির্যাস ।তাঁর মা রাহাত আরা বেগম ছিলেন একজন কবি। সেসময়ে অবিভক্ত ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ডাকঘর” রচনাটি উর্দুতে অনুবাদ করে তিনি বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন। রাহাত আরা বেগমের প্রভাব অধ্যাপক ইসলামের মধ্যে বিদ্যমান। আবার আরেকদিকে তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া ইসলাম তাঁকে সবসময়ই প্রেরণা জুগিয়ে গিয়েছেন দেশে ফিরে আসার জন্য। তাঁর জন্য  তিনি নিজের সুন্দর ক্যারিয়ারের দিকেও কখনো তাকাননি।নিজে ডক্টরেট ছিলেন,কিন্তু অধ্যাপক ইসলামকে পরিপূর্ণ করতে গিয়ে কখনো সেভাবে নিজের ভবিষ্যতের দিকে তাকান নি তিনি। সেরকম একজন স্ত্রীর ,একজন নারীর স্বামী কেনই বা মানবতাবাদী হবেন না? অধ্যাপক ইসলাম আর সুরাইয়া ইসলাম একজন আরেকজনের পরিপূরক ছিলেন।
অধ্যাপক ইসলামকে নিয়ে লিখতে গেলে পাতার পর পাতা লিখা যায়। বাংলা সাহিত্যে একহাতে রণতূর্য আর একহাতে কলম নিয়ে আবির্ভাব ঘটেছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের।আর একদিকে বিজ্ঞানচর্চা ,অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন ও গভীর জীবনবোধ নিয়ে আবির্ভাব ঘটেছে জামাল নজরুল ইসলামের। বিজ্ঞান আর শিল্পের এমন ধ্রুপদী মিলন করানো বোধ হয় একজন অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের পক্ষেই সম্ভব ছিল। অধ্যাপক ইসলাম বেঁচে আছেন তাঁর কাজের মধ্যে, তাঁর শিল্পের মধ্যে। বেঁচে থাকলে এখনো হয়তো সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আবৃত্তি করে উঠতেন “দুই বিঘা জমি” কিংবা ‘বিদ্রোহী” কবিতা।অথবা কোনো আসরে তাঁকে পাওয়া যেত বাহাদুর শাহ জাফরের গজল গাইতে,

“ উমর ই দরাজ মাঙ্গ কার লায়ে থে চারদিন/ দো আরজু মে কাট গায়ে,দো ইন্তেজার মে।
( আমি চারদিনের আয়ু খুঁজে নিয়ে এসেছিলাম ,দুইদিন কেটেছিল আশায় ,দুইদিন অপেক্ষায়”

তথ্যসূত্রঃ
১।বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম –শরীফ মাহমুদ ছিদ্দিকী।
২।মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ-জামাল নজরুল ইসলাম
৩। শিল্প,সাহিত্য ও সমাজ-জামাল নজরুল ইসলাম
৪।বিশদ আড্ডা –মাসিক বিশদ সংবাদ ,আগস্ট ২০০৭(সাক্ষাতকার নিয়েছেন আলম খোরশেদ ও এহসানুল কবির)
৫। বিশ্বনন্দিত গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী-অজয় রায়,প্রথম আলো।
৬। একজন জামাল নজরুল ইসলাম ও মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ -অভিজিৎ রায়
৭।আমাদের অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ,এ এম হারুন অর রশীদ,বিডিনিউজ ২৪ ডট কম।
৮।সার্সেন রোডের পিয়ানো বাজানো মানুষটি,প্রিয়ম মজুমদার,বিডিনিউজ ২৪ ডট কম।
৯। জামাল স্যারকে নিয়ে কয়েক টুকরো স্মৃতি,আরশাদ মোমেন,বিডিনিউজ ২৪ ডট কম।
১০। যে মানুষটি মহাবিশ্বকে গুনতে বসেছিল,ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী,বিডিনিউজ ২৪ ডট কম।
১১।দার্শনিক বিজ্ঞানী প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম,ফরহাদ মজহার,দৈনিক পূর্বকোণ।   

Comments