মান্টোর গল্পঃ পার্টিশন আর দাঙ্গার এক দগদগে ক্ষত
(১)
পার্টিশন নিয়ে বহুজন বহু লিখা লিখেছেন। সেসব লিখা লেখক যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তারই বহিঃপ্রকাশ। রাতারাতি ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে জন্ম নিল পাকিস্তান। পার্টিশনের আগে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ ছিল নিত্তনৈমিত্তিক এক ব্যাপার। পার্টিশনের পর লুটপাট হয়ে গেল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। চরমতম এক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে। আর তাই পার্টিশনের ইতিহাস হয়ে গেল আমাদের ইতিহাস, পার্টিশন হয়ে গেল আমাদের গল্প। ইতিহাস তো আসলে অতীত না,বর্তমান। বর্তমানে বসে অতীতের কোনো ঘটনাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করছি, কোন ঘটনাকে বিশ্লেষণ করছি সেটাই তো ইতিহাস হয়ে উঠে। আমাদের পার্টিশনের ইতিহাসের দলিল ঘেটে যেমন সে সময়কার বিভিন্ন তথ্য পাই, তেমনি পাই সে সময়ের গল্পগুলোতে। সেই সব গল্পগুলোর মধ্যে আছে পার্টিশন নিয়ে নানা স্বপ্ন, নানা স্বপ্নভঙ্গ। তেমনই একজন গল্পকার মান্টো। সাদত হাসান মান্টো। মান্টো শব্দের অর্থ দেড় সের পাথর। এই দেড়সের পাথরই আমাদের বিশাল এক পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়, একটা বিশাল সমুদ্রের ঢেউকে থামিয়ে দিতে চায়। মান্টোর জন্ম পাঞ্জাবের লুধিয়ানায়। অমৃতসর, আলীগড়, দিল্লী,বোম্বে, লাহোরে। পার্টিশনের আগে মান্টো ছিলেন বোম্বেতে। আটচল্লিশের জানুয়ারিতে গেলেন লাহোরে৷ অনেকদিন ধরে তাঁর মস্তিষ্ক পার্টিশনকে মেনে নিতে পারে নি। তিনি লিখছেন,
পার্টিশন নিয়ে বহুজন বহু লিখা লিখেছেন। সেসব লিখা লেখক যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তারই বহিঃপ্রকাশ। রাতারাতি ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে জন্ম নিল পাকিস্তান। পার্টিশনের আগে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ ছিল নিত্তনৈমিত্তিক এক ব্যাপার। পার্টিশনের পর লুটপাট হয়ে গেল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। চরমতম এক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে। আর তাই পার্টিশনের ইতিহাস হয়ে গেল আমাদের ইতিহাস, পার্টিশন হয়ে গেল আমাদের গল্প। ইতিহাস তো আসলে অতীত না,বর্তমান। বর্তমানে বসে অতীতের কোনো ঘটনাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করছি, কোন ঘটনাকে বিশ্লেষণ করছি সেটাই তো ইতিহাস হয়ে উঠে। আমাদের পার্টিশনের ইতিহাসের দলিল ঘেটে যেমন সে সময়কার বিভিন্ন তথ্য পাই, তেমনি পাই সে সময়ের গল্পগুলোতে। সেই সব গল্পগুলোর মধ্যে আছে পার্টিশন নিয়ে নানা স্বপ্ন, নানা স্বপ্নভঙ্গ। তেমনই একজন গল্পকার মান্টো। সাদত হাসান মান্টো। মান্টো শব্দের অর্থ দেড় সের পাথর। এই দেড়সের পাথরই আমাদের বিশাল এক পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়, একটা বিশাল সমুদ্রের ঢেউকে থামিয়ে দিতে চায়। মান্টোর জন্ম পাঞ্জাবের লুধিয়ানায়। অমৃতসর, আলীগড়, দিল্লী,বোম্বে, লাহোরে। পার্টিশনের আগে মান্টো ছিলেন বোম্বেতে। আটচল্লিশের জানুয়ারিতে গেলেন লাহোরে৷ অনেকদিন ধরে তাঁর মস্তিষ্ক পার্টিশনকে মেনে নিতে পারে নি। তিনি লিখছেন,
"যখনই লিখতে বসছি তখনই সব কেমন যেন বিচ্ছিন্ন লাগছিল। অনেক কষ্ট করেও ভারতকে পাকিস্তান থেকে আর পাকিস্তানকে ভারত থেকে আলাদা করতে পারছিলাম না। সবকিছু গুলিয়ে মাথার ভেতর খালি একটা প্রশ্নই ঘুরছিল,পাকিস্তানের সাহিত্যও কি ভাগ হয়ে গেছে! যদি হয় তাহলে কীভাবে? আমার ঐসব লিখা যা আমি স্বাধীন হিন্দুস্তানে লিখেছি, তার মালিক কে? ওগুলোও কি ভাগ করা হবে?"
--অবিরাম ব্যথার কিছু কথা(ঠান্ডা গোশতের ভূমিকা)
মান্টোর গল্পে পার্টিশন নতুন এক মাত্রা পেল। কেউ তাকে অশ্লীলতা বলল, কেউ সাধুবাদ জানাল। 'ঠান্ডা গোশত' তাকে আদালত পর্যন্ত নিয়ে গেল। অশ্লীলতার দায় মাথায় নিয়ে মান্টো বললেন,
"যদি আমার গল্প অশ্লীল হয় তবে এই সমাজ অশ্লীল। কারণ আমার গল্প এই সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।" সাহিত্যের শ্লীল-অশ্লীলতা কিসের ভিত্তিতে নির্ণয় করা হয় আমার জানা নেই। তবে মান্টোর গল্প যে অশ্লীল নয়, রূঢ় বাস্তবতা এটুকু বলাই যায়। পার্টিশনের পর মান্টো পাকিস্তানে গিয়ে 'ঠান্ডা গোশত' গল্পটাই সম্ভবত সর্বপ্রথম লিখেন। কিন্তু কোনো প্রকাশক সেটা প্রকাশে নারাজ হলে মান্টো 'খোল দো' গল্পটা লিখেন এবং 'নকুশ' পত্রিকায় ছাপার জন্য দেন। কিছুদিন পর নকুশের উপর ছয়মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। মান্টোর জীবনে এরকম অনেক গল্পের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। মান্টোকে বুঝতে গেলে তখনকার বাস্তবতাকে বুঝতে হবে। কারণ মান্টো যে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, সে বাস্তবতাকেই নিজের কলমে তুলে এনেছেন। সেখানে কৃত্রিমতার ছিটেফোঁটা নেই। তাই সেখানে মানুষের কদর্য রূপটাই আমরা বেশি দেখতে পাই। বিশেষ করে পার্টিশনের গল্পগুলোতে মান্টো বাস্তবতাকে ধরে রাখার যে প্রয়াস চালিয়েছেন তার জন্য সাধুবাদ জানাতেই হয়। 'সিয়াহ হাশিয়ে' গল্পগ্রন্থে মান্টো নিজের আবেগকে চেপে ধরে স্রেফ বাস্তবতা,সময়কে তুলে ধরেছেন। এজন্যই মান্টো অন্যদের থেকে আলাদা।
(২)
পার্টিশন নিয়ে মান্টোর গল্পগ্রন্থের কথা বলতে গেলে 'ঠান্ডা গোশত' এর কথাই সর্বপ্রথম আসে। আর আসে 'সিয়াহ হাশিয়ে'র কথা। 'সিয়াহ হাশিয়ে'র বাংলা কালো সীমানা। এই তর্জমা নিয়ে জাভেদ হুসেন বলছেন,
পার্টিশন নিয়ে মান্টোর গল্পগ্রন্থের কথা বলতে গেলে 'ঠান্ডা গোশত' এর কথাই সর্বপ্রথম আসে। আর আসে 'সিয়াহ হাশিয়ে'র কথা। 'সিয়াহ হাশিয়ে'র বাংলা কালো সীমানা। এই তর্জমা নিয়ে জাভেদ হুসেন বলছেন,
"এই নাম দ্ব্যর্থবোধক। এক অর্থে কালো সীমানা নতুন দেশের বর্ডার, মান্টো যাকে কালোই বলতেন। আরেক অর্থ হলো, পত্রিকায় কোনো শোকসংবাদ বা দুঃখের সংবাদ যে কালো বর্ডারে ছাপানো হয় সেই কালো সীমানা। "এই গ্রন্থে ৩২ টি গল্প আছে। কিছু গল্প দু লাইনের। কিছু গল্প এক প্যারার,কিছু গল্প সর্বোচ্চ এক পাতার। অথচ কোনো গল্পই অসম্পূর্ণ নয়। বরং গল্পগুলো এতটা গভীর আর এতটা জীবন্ত যে পাঠক ক্ষণিকের জন্য বাস্তবতা থেকে দূরে সেই সাতচল্লিশে চলে যাবে। এই গ্রন্থের গল্পগুলো যেন সময়ের জলজ্যান্ত ফটোফ্রেম। মান্টো যেন কোনো গল্প লিখছেন না,ছবি তুলছেন। সেই ছবিগুলো বারবার আমাদের সাতচল্লিশে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এই গল্পগুলোকে সার্থক করে তোলার জন্য মান্টোকে অনেক নিষ্ঠুর হতে হয়। নিজের আবেগ, ভালো লাগা, কজগোভ, বেদনা সবকিছুকে এক পাশে রেখে মান্টো গল্প বলে গেছেন। জাভেদ হুসেন কালো সীমানা নামকরণে দ্বিতীয় যে ব্যাখাটি দিলেন এই গ্রন্থের গল্পগুলো পড়লে যেন বারবার সেটাকেই সত্য মনে হবে। মনে হবে এগুলো গল্প নয়। সাতচল্লিশের বা তার পরের কোনো পত্রিকার শোকসংবাদ আর তার বর্ণনাগুলো একত্রিত করা হয়েছে এ গ্রন্থে।
-জাভেদ হুসেন(কালো সীমানা,২০১৯)
মানুষে মানুষে বিভেদের যে দেয়াল সে দেয়াল কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সাতচল্লিশের পার্টিশন। হিন্দু-মুসলিম, শিখ-মুসলিম কিংবা অন্যান্য ধর্মের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার যে কঠিনতম এক রূপ সাতচল্লিশে তৈরি হয়েছিল সেই রূপের ভুক্তভোগী আজও ভারত উপমহাদেশ। কেউ জিন্নাহর পিন্ডি চটকায় তো কেউ গান্ধীর। সে সময়েই গান্ধীর মৃত্যু সংবাদ শুনে মিষ্টি বিতরণ হয় পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায়। মান্টো সেটাকেই তুলে ধরেছেন। সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে লুটপাট ছিল একটা সাধারণ বিষয়। সেই লুটপাটকে বারবার নিজের কলমে এঁকেছেন মান্টো। 'সিয়াহ হাশিয়ে' র অনেক গল্পই এই লুটপাট নিয়ে। কখনোবা সেই লুটপাটের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। কখনো কখনো লুটের মালে ভাগ চেয়ে বসে পুলিশ। আবার দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কখনো জৈন ধর্মের লোকেরা জীব হত্যা পাপ বলে অন্য ধর্মের লোকদের দিয়ে এক দম্পতিকে খুন করায়। আবার দেখা যায় খতনা করিয়ে কোনো হিন্দু নিজ সম্প্রদায়ের লোকের কাছে আর গ্রহণযোগ্য হয় না। বরং সীমানা পাড়ি দেয়ার সময় করা এই ছোট্ট 'ভুল' সংশোধন করে তার ওই সাথীরা।
এই পার্টিশন-দাঙ্গার গল্প যখন মান্টো তুলে আনছেন তখন তিনি কী নিষ্ঠুরতম এক বাস্তবতাকে তুলে আনছেন! রাস্তায় পড়ে থাকা রক্তে বরফ পড়ে থকথকে হয়ে যাওয়ায় কোনো বাচ্চার জেলী ভেবে জিভে জল আসার দৃশ্য দেখাচ্ছেন মান্টো। এত খুন, এত লুটপাটের দিনে ছোট্ট বাচ্চার রক্ত দেখে জেলী ভাবাটা আর দৃশ্যটা গল্পে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রচুর পরিমাণ মানসিক শক্তি লাগে। সে শক্তি মান্টোর ছিল বইকি। মান্টো এক্ষেত্রে অসাধারণ। কিংবা বলব নিতান্তই সাধারণ। যে সাধারণের রাগ আছে, দুঃখ আছে, ক্ষোভ আছে, কিন্তু সে তা প্রকাশ করতে পারে না। সিয়াহ হাশিয়েতে আরো কিছু চমৎকার গল্প আছে। সেই গল্পগুলোর কোনোটিতে ধর্মান্তরিত হওয়ার লজ্জায় আত্মহত্যা করার কথা আছে, কোনোটিতে আবার ধর্মান্তরিত হতে না চাওয়ার দৃঢ়তা আছে, আবার কখনো ধর্মান্তরিত না হতে চাওয়ায় মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার কথা আছে। সাতচল্লিশে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল নারীদের পণ্য হিসেবে বিক্রি। কিংবা কখনো জওয়ান মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা। সিয়াহ হাশিয়েতে 'লোকসান' নামের এক গল্পে আমরা দেখি দুই বন্ধু মউজ মাস্তির জন্য অন্য ধর্মের এক মেয়েকে কিনে আনে। সারারাত কাটানোর পর দুই বন্ধু যখন জানতে পারে মেয়েটি তাদেরই ধর্মের তখন তারা বিক্রেতাকে আচ্ছা করে গাল দেয়। এই যে মান্টোর গল্পে খুবই সাধারণভাবে এসব কথা উঠে এসেছে এটাই বোধ হয় মান্টোর সবচেয়ে অসাধারণত্বের জায়গা।
(৩)
এবার আসা যাক ঠান্ডা গোশতের কথায়। ঠান্ডা গোশত গ্রন্থটিতে যে কটা গল্প স্থান পেয়েছে তার সবগুলোই একটি অপরটির থেকে আলাদা,স্বতন্ত্র এবং সাবলীল। 'ঠান্ডা গোশত' গল্পটির কথাই বলা যাক। ঈশ্বর সিং কিংবা কলবন্ত কাউরের আলাপের মধ্যে কলবন্ত যখন তৃতীয় একজমের অস্তিত্ব অনুভব করে সে সিং এর উপর হামলে পড়ে। সিং এরপর তাকে লুটপাটের গল্প বলে, ঠান্ডা গোশতের কথা বলে। একটা মৃত মানুষকে জীবন্ত মনে করে কাধে করে নিয়ে এসে সহবাসের জন্য যখন সে এগিয়ে যায় তখন সে ঠান্ডা গোশতের অনুভূতি পায়৷ মান্টো এই গল্পটাকে যেভাবে সাজিয়েছেন তা প্রশংসার দাবী রাখে। অবশ্য প্রশংসাস্বরূপ মান্টো পুরুষ্কার না পেলেও আদালতের চক্করে ঠিকই পড়েছেন। কখনোবা কোনো মৌলভীর প্রশ্নবানে পড়েছেন, "আমরা মুসলমানরা কী এতই দুর্বল,আমরা আমাদের নারীদের হেফাজত করতে পারব না!" মান্টো সত্যিকার অর্থেই সমাজের এক আয়না সমাজের সামনে তুলে ধরেছিলেন। সে আয়নায় নিজেদের কদর্য রূপ দেখেই মান্টোর উপর সবাই ক্ষেপেছেন। মান্টোর গল্প সত্যিকারই সমাজের প্রতিচ্ছবি। ঠান্ডা গোশতেরই আরেকটি গল্প 'গোলি'। যেখানে প্রতিবন্ধী এক নারীর প্রতি এক পুরুষের সহানুভূতি জেগে উঠে। তার স্ত্রীও সেই নারীর প্রতি সহানুভূতি দেখান। একটা মুহুর্তে স্ত্রী যখন সেই নারীর জন্য সুযোগ্য পাত্র খোঁজার প্রস্তাব রাখে। তার স্বামী যখন সেই নারীকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখে তখম স্ত্রীর চোখ থেকে সহানুভূতি সরে গিয়ে এক ক্রোধ জন্ম নেয়। এবং সে তার স্বামীকে বলে সে যদি এ কাজ করে তবে সে নারীকে তার স্ত্রী গুলি করবে। খুবই সাধারণ এক ঘটনার অসাধারণ এক পরিবেশন এ গল্প।
এ গ্রন্থে আমরা 'সাড়ে তিন আনা' নামের এক গল্প পাই। এই গল্প মান্টোর সাথে রিজভী নামক এক ব্যক্তির আলাপ। রিজভী যেখানে বক্তা। রিজভী সেখানে এক মেথরের গল্প বলে। যে মেথর সাড়ে তিন আনা চুরির জন্য এক বছর জেলের শাস্তি পেয়েছিল। এবং কথকের সাথে একই সেলে ছিল। গল্পকথকের কোনো এক বন্ধু যখন ঐ মেথরের দ্বারাই তার বন্ধুর কাছে চিঠিসহ দশটাকা পাঠায়, সে চিঠিতে লিখে পুরোনো এক চোরের হাতে দশ টাকা পাঠাচ্ছে। সে টাকা কতটা নিরাপদ সে জানে না। চিঠি পড়ে রিজভী হাসতে হাসতে ভাবল যে লোকের সাড়ে তিন আনা চুরির দায়ে এক বছর জেল হলো, দশটাকা চুরিতে তার শাস্তি কতদিনের হবে! এ গ্রন্থের গল্পগুলো পড়লেই মান্টোর উপর কতিপয় মানুষের ক্ষোভের যে জায়গা সেটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মান্টো এখানে মানুষের সে কদর্য রূপগুলাকে তুলে এনেছেন যেগুলোর মুখোমুখি হতে সে ভয় পায়। মান্টো বারবার এ কাজটি করেছেন। তাই তার গল্প অশ্লীলতার খেতাব পেয়েছে। অশ্লীল বলে তার গল্প নিষিদ্ধ হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু মান্টো অশ্লীল ছিলেন না। সাহিত্য অশ্লীল হয় না। মান্টো স্রেফ জলজ্যান্ত এক ক্যামেরা ছিলেন, যিনি আশপাশের বাস্তবতাকে বিন্দুমাত্র না বদলে একটার পর একটা ছবি তুলে গেছেন। সে ছবি কখনো মানুষের লেগেছে, তখন মান্টো প্রশংসা পেয়েছে, আবার কখনো সে ছবির সম্মুখীন হতে মানুষ চায় নি। তাই মান্টোকে গালিগালাজ করেছে, তার গল্প নিষিদ্ধের দাবী তুলেছে। দেড় সের পাথর হয়ে পুরো ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দিতে বোধ হয় কেবল মান্টোই পারতেন।
এবার আসা যাক ঠান্ডা গোশতের কথায়। ঠান্ডা গোশত গ্রন্থটিতে যে কটা গল্প স্থান পেয়েছে তার সবগুলোই একটি অপরটির থেকে আলাদা,স্বতন্ত্র এবং সাবলীল। 'ঠান্ডা গোশত' গল্পটির কথাই বলা যাক। ঈশ্বর সিং কিংবা কলবন্ত কাউরের আলাপের মধ্যে কলবন্ত যখন তৃতীয় একজমের অস্তিত্ব অনুভব করে সে সিং এর উপর হামলে পড়ে। সিং এরপর তাকে লুটপাটের গল্প বলে, ঠান্ডা গোশতের কথা বলে। একটা মৃত মানুষকে জীবন্ত মনে করে কাধে করে নিয়ে এসে সহবাসের জন্য যখন সে এগিয়ে যায় তখন সে ঠান্ডা গোশতের অনুভূতি পায়৷ মান্টো এই গল্পটাকে যেভাবে সাজিয়েছেন তা প্রশংসার দাবী রাখে। অবশ্য প্রশংসাস্বরূপ মান্টো পুরুষ্কার না পেলেও আদালতের চক্করে ঠিকই পড়েছেন। কখনোবা কোনো মৌলভীর প্রশ্নবানে পড়েছেন, "আমরা মুসলমানরা কী এতই দুর্বল,আমরা আমাদের নারীদের হেফাজত করতে পারব না!" মান্টো সত্যিকার অর্থেই সমাজের এক আয়না সমাজের সামনে তুলে ধরেছিলেন। সে আয়নায় নিজেদের কদর্য রূপ দেখেই মান্টোর উপর সবাই ক্ষেপেছেন। মান্টোর গল্প সত্যিকারই সমাজের প্রতিচ্ছবি। ঠান্ডা গোশতেরই আরেকটি গল্প 'গোলি'। যেখানে প্রতিবন্ধী এক নারীর প্রতি এক পুরুষের সহানুভূতি জেগে উঠে। তার স্ত্রীও সেই নারীর প্রতি সহানুভূতি দেখান। একটা মুহুর্তে স্ত্রী যখন সেই নারীর জন্য সুযোগ্য পাত্র খোঁজার প্রস্তাব রাখে। তার স্বামী যখন সেই নারীকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখে তখম স্ত্রীর চোখ থেকে সহানুভূতি সরে গিয়ে এক ক্রোধ জন্ম নেয়। এবং সে তার স্বামীকে বলে সে যদি এ কাজ করে তবে সে নারীকে তার স্ত্রী গুলি করবে। খুবই সাধারণ এক ঘটনার অসাধারণ এক পরিবেশন এ গল্প।
এ গ্রন্থে আমরা 'সাড়ে তিন আনা' নামের এক গল্প পাই। এই গল্প মান্টোর সাথে রিজভী নামক এক ব্যক্তির আলাপ। রিজভী যেখানে বক্তা। রিজভী সেখানে এক মেথরের গল্প বলে। যে মেথর সাড়ে তিন আনা চুরির জন্য এক বছর জেলের শাস্তি পেয়েছিল। এবং কথকের সাথে একই সেলে ছিল। গল্পকথকের কোনো এক বন্ধু যখন ঐ মেথরের দ্বারাই তার বন্ধুর কাছে চিঠিসহ দশটাকা পাঠায়, সে চিঠিতে লিখে পুরোনো এক চোরের হাতে দশ টাকা পাঠাচ্ছে। সে টাকা কতটা নিরাপদ সে জানে না। চিঠি পড়ে রিজভী হাসতে হাসতে ভাবল যে লোকের সাড়ে তিন আনা চুরির দায়ে এক বছর জেল হলো, দশটাকা চুরিতে তার শাস্তি কতদিনের হবে! এ গ্রন্থের গল্পগুলো পড়লেই মান্টোর উপর কতিপয় মানুষের ক্ষোভের যে জায়গা সেটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মান্টো এখানে মানুষের সে কদর্য রূপগুলাকে তুলে এনেছেন যেগুলোর মুখোমুখি হতে সে ভয় পায়। মান্টো বারবার এ কাজটি করেছেন। তাই তার গল্প অশ্লীলতার খেতাব পেয়েছে। অশ্লীল বলে তার গল্প নিষিদ্ধ হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু মান্টো অশ্লীল ছিলেন না। সাহিত্য অশ্লীল হয় না। মান্টো স্রেফ জলজ্যান্ত এক ক্যামেরা ছিলেন, যিনি আশপাশের বাস্তবতাকে বিন্দুমাত্র না বদলে একটার পর একটা ছবি তুলে গেছেন। সে ছবি কখনো মানুষের লেগেছে, তখন মান্টো প্রশংসা পেয়েছে, আবার কখনো সে ছবির সম্মুখীন হতে মানুষ চায় নি। তাই মান্টোকে গালিগালাজ করেছে, তার গল্প নিষিদ্ধের দাবী তুলেছে। দেড় সের পাথর হয়ে পুরো ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দিতে বোধ হয় কেবল মান্টোই পারতেন।
(৪)
এখন আরও দুটো গল্প নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। প্রথমটি 'টোবাটেক সিং'। এই গল্পে দেখা যায় সাতচল্লিশের কিছু সময় পর ভারত-পাকিস্তান দুদেশের বন্দি বিনিময়ের সময়ে পাগল বিনিময়ও হয়। ভারতে যেসব মুসলমান পাগল ছিল তাদের পাকিস্তান পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় আর পাকিস্তানে যেসব হিন্দু আর শিখ পাগল ছিল তাদেরকে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ গল্পের বশন সিং বা টোবাটেক সিং এরকমই একজন পাগল। ১৫ বছর ধরে যে কখনো ঘুমোয় নি। সে বারবার নিজের অস্তিত্বর কাছে যেন প্রশ্ন করে "টোবাটেক সিং কোথায়? পাকিস্তানে না হিন্দুস্থান?" কেউ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। শুধু টোবাটেক সিং না, অন্যান্য সকল পাগলের মধ্যেও এ এক আশ্চর্যজনক প্রশ্ন "তার ভারতীয় না পাকিস্তানি?" পার্টিশন কী, কোনটা ভারত কোনটা পাকিস্তান সেটা কেউ যেন আলাদা করতে পারছিল না। কেউ কেউ আবার গাছের উপরে উঠে বলে "আমি ভারতেও যাব না, পাকিস্তানেও যাব না। আমি এই গাছে থাকব। " আবার দেখা যায় পাগল বিনিময়ের সময় নো ম্যানস ল্যাণ্ডে টোবাটেক সিং এর মৃত্যু হয়। সে না হয় ভারতীয়, না হয় পাকিস্তানি। এই পাকিস্তান-ভারত এই অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব খোদ মান্টোর। এই দ্বন্দ্ব থেকে মান্টোর মস্তিষ্ক মুক্তি পায় নি। কোনটি পাকিস্তান আর কোনটি ভারত মান্টোর মস্তিষ্ক যেন তা আলাদা করতে পারে না।
দ্বিতীয় গল্পটি হলো, 'লাইসেন্স'। লাইসেন্স গল্পটি চাইলেই সাদাসিধে এক প্রেমের কাহিনী হতে পারত। কিন্তু তা না হয়ে বরং গল্পটি অন্য একটি মোড় নেয়। দেখা যায় আব্বু কেচোয়ান আর ইনায়েত বা নীতির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে আর তারা বিয়ে করে। কিন্তু এমনই সময়ে একটি অপহরণ মামলায় আব্বুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবং কারাগারে থাকা অবস্থাতেই ক্ষয়রোগে আব্বুর মৃত্যু হয়। ইনায়েত নিজেকে সামলে নেয় এবং আব্বুর টাঙ্গা ঘোড়া তার চাচাত ভাইকে দিয়ে ভাড়া আদায় করত। এক সময়ে সে বিয়ের প্রস্তাব দিলে এবং ইনায়েত তা প্রত্যাখ্যান করলে সেই ভাড়ার পরিমাণ দিনদিন কমতে থাকে। ইনায়েত তাই বাধ্য হয়ে টাঙ্গা ঘোড়া ফেরত নেয় এবং নিজেই চালাতে লাগে। সারা শহর এমন এক নারীর টাঙ্গা চালানো দেখে অবাক হয়। অনেকেই এর বিরোধিতাও করে। একটা সময়ে মেয়েরা টাঙ্গা চালাতে পারবে না বলে ফরমান জারি হয় এবং এক অফিসার ইনায়েতকে ধরে নিয়ে যায়। ইনায়েত মজদুরিতে সমস্যা কী জিজ্ঞেস করলে সে অফিসার তাকে দেহব্যবসার কথা বলে। সেদিনই ইনায়েত নতুন এক লাইসেন্স লাভ করে, দেহব্যবসার লাইসেন্স। মান্টোর এই গল্পটা সমাজের রক্ষণশীলতার মুখে এক চড় ছিল। পার্টিশন কিংবা এর পরে নারীর প্রতি সমাজের যে হেয় দৃষ্টিভঙ্গি সেটাকেই প্রবল কষাঘাত করেছেন মান্টো। আর তাই 'লাইসেন্স' হয়ে উঠেছে অনন্য অসাধারণ। এরকম আরও অনেক গল্পেই মান্টো পার্টিশন বা পার্টিশনকে ঘিরে দাঙ্গাকে নিয়ে লিখেছেন।
এখন আরও দুটো গল্প নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। প্রথমটি 'টোবাটেক সিং'। এই গল্পে দেখা যায় সাতচল্লিশের কিছু সময় পর ভারত-পাকিস্তান দুদেশের বন্দি বিনিময়ের সময়ে পাগল বিনিময়ও হয়। ভারতে যেসব মুসলমান পাগল ছিল তাদের পাকিস্তান পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয় আর পাকিস্তানে যেসব হিন্দু আর শিখ পাগল ছিল তাদেরকে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ গল্পের বশন সিং বা টোবাটেক সিং এরকমই একজন পাগল। ১৫ বছর ধরে যে কখনো ঘুমোয় নি। সে বারবার নিজের অস্তিত্বর কাছে যেন প্রশ্ন করে "টোবাটেক সিং কোথায়? পাকিস্তানে না হিন্দুস্থান?" কেউ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। শুধু টোবাটেক সিং না, অন্যান্য সকল পাগলের মধ্যেও এ এক আশ্চর্যজনক প্রশ্ন "তার ভারতীয় না পাকিস্তানি?" পার্টিশন কী, কোনটা ভারত কোনটা পাকিস্তান সেটা কেউ যেন আলাদা করতে পারছিল না। কেউ কেউ আবার গাছের উপরে উঠে বলে "আমি ভারতেও যাব না, পাকিস্তানেও যাব না। আমি এই গাছে থাকব। " আবার দেখা যায় পাগল বিনিময়ের সময় নো ম্যানস ল্যাণ্ডে টোবাটেক সিং এর মৃত্যু হয়। সে না হয় ভারতীয়, না হয় পাকিস্তানি। এই পাকিস্তান-ভারত এই অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব খোদ মান্টোর। এই দ্বন্দ্ব থেকে মান্টোর মস্তিষ্ক মুক্তি পায় নি। কোনটি পাকিস্তান আর কোনটি ভারত মান্টোর মস্তিষ্ক যেন তা আলাদা করতে পারে না।
দ্বিতীয় গল্পটি হলো, 'লাইসেন্স'। লাইসেন্স গল্পটি চাইলেই সাদাসিধে এক প্রেমের কাহিনী হতে পারত। কিন্তু তা না হয়ে বরং গল্পটি অন্য একটি মোড় নেয়। দেখা যায় আব্বু কেচোয়ান আর ইনায়েত বা নীতির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে আর তারা বিয়ে করে। কিন্তু এমনই সময়ে একটি অপহরণ মামলায় আব্বুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবং কারাগারে থাকা অবস্থাতেই ক্ষয়রোগে আব্বুর মৃত্যু হয়। ইনায়েত নিজেকে সামলে নেয় এবং আব্বুর টাঙ্গা ঘোড়া তার চাচাত ভাইকে দিয়ে ভাড়া আদায় করত। এক সময়ে সে বিয়ের প্রস্তাব দিলে এবং ইনায়েত তা প্রত্যাখ্যান করলে সেই ভাড়ার পরিমাণ দিনদিন কমতে থাকে। ইনায়েত তাই বাধ্য হয়ে টাঙ্গা ঘোড়া ফেরত নেয় এবং নিজেই চালাতে লাগে। সারা শহর এমন এক নারীর টাঙ্গা চালানো দেখে অবাক হয়। অনেকেই এর বিরোধিতাও করে। একটা সময়ে মেয়েরা টাঙ্গা চালাতে পারবে না বলে ফরমান জারি হয় এবং এক অফিসার ইনায়েতকে ধরে নিয়ে যায়। ইনায়েত মজদুরিতে সমস্যা কী জিজ্ঞেস করলে সে অফিসার তাকে দেহব্যবসার কথা বলে। সেদিনই ইনায়েত নতুন এক লাইসেন্স লাভ করে, দেহব্যবসার লাইসেন্স। মান্টোর এই গল্পটা সমাজের রক্ষণশীলতার মুখে এক চড় ছিল। পার্টিশন কিংবা এর পরে নারীর প্রতি সমাজের যে হেয় দৃষ্টিভঙ্গি সেটাকেই প্রবল কষাঘাত করেছেন মান্টো। আর তাই 'লাইসেন্স' হয়ে উঠেছে অনন্য অসাধারণ। এরকম আরও অনেক গল্পেই মান্টো পার্টিশন বা পার্টিশনকে ঘিরে দাঙ্গাকে নিয়ে লিখেছেন।
(৫)
মান্টো সবসময় বলতেন সাদত হাসান আর মান্টো দুইটি সত্তা। তাহলে মান্টো কে? মান্টো নিজেই লিখছেন,
মান্টো সবসময় বলতেন সাদত হাসান আর মান্টো দুইটি সত্তা। তাহলে মান্টো কে? মান্টো নিজেই লিখছেন,
" আমি তোমাদের খুব জোর গলায় বলতে পারি যে মান্টো, যার বিরুদ্ধে এত অশ্লীলতার অভিযোগ রয়েছে, আদতে আপাদমাথা ভদ্রলোক। কিন্তু একথাও বলে রাখি এর সঙ্গে যে সে আসলে নিরন্তর ঝাড়পোঁছ করে চলেছে নিজেকে।"যে ঠান্ডা গোশতের জন্য মান্টোকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে, দিনের পর দিন দৌঁড়ে বেড়াতে হয়েছে সেই ঠান্ডা গোশত নিয়েই মান্টো বলছেন,
"ঠান্ডা গোশত গল্পে যা কিছু বলা হয়েছে তা একদম স্পষ্ট। এতে অশ্লীলতার কিছুই নেই। তাছাড়া গল্পটির নিরঙ্কুশতার অন্যতম প্রমাণ হলো এটি পাঠে পাঠকের হৃদয়ে কোনোরকম যৌনতা বা বোধে অশ্লীল প্রতিক্রিয়া জাগে না। বরং ভয় জাগবে। আসলে প্রকৃত যে ঘটনা ঈশ্বর সিংয়ের সাথে ঘটেছে এ অবস্থা পাঠকের মনে কী কোনো যৌনতা জাগাতে পারে!"মান্টো যখন সাহিত্যের শ্লীল-অশ্লীলতা নিয়ে লড়াই করছিলেন তখন তার অনেক প্রগতিশীল বন্ধুই তার সাথে ছিল না। এমনকি অনেকে তো মান্টোর বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ এনেছেন যে মান্টো নাকি লাশের পকেট থেকে সিগারেট নিয়ে খেতেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রও কখনো মান্টোকে অশ্লীল গল্পের লেখক হিসেবে চালিয়ে দিত তো কখনো মান্টোকে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ লেখক তকমা দিত। তাই মান্টো লিখেছেন,
---অবিরাম ব্যথার কিছু কথা
"আজ আমার মন খুব খারাপ। কারণ, আগে আমাকে প্রগতিশীলদের মধ্যে হিসাব করা হতো,পরে আমাকে একেবারে প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে দেয়া হলো। আর এখন ফতোয়াবাজেরা ভাবছে, কী করে আমাকে আবার প্রগতিশীল বানানো যায়। আর ফতোয়াবাজদের ওপর ফতোয়া দেনেওয়ালা সরকার বিশ্বাসই করে আমি প্রগতিশীল। এরা কখনো আমার নামে অশ্লীল কমিউনিস্ট বলে মামলাও করে দেয়। এই সরকারই আবার বিজ্ঞাপন দেয় যে সাদত হাসান মান্টো আমাদেত দেশের একজন বড় সাহিত্যিক, যাঁর কলম বহু ঝামেলাতেও থামে নি। আমার ভয় হয়, এই সরকার আবার খুশি হয়ে আমার কাফনে কোনো পদক না ঝুলিয়ে দেয়। তাহলে সে পদক আমার প্রেমের বেদনার বড় অপমান হয়ে থাকবে। "সাদত হাসান মান্টো এ কারণে সবার থেকে আলাদা ছিলেন যে তিনি স্পষ্টভাষী ছিলেন। সাদত হাসান মান্টো এ কারণে সবার থেকে আলাদা ছিলেন যে তিনি সত্য বলতে ভয় পেতেন না। তিনি কারো দ্বারা প্রভাবিত হতে চান নি। চান নি বড় বড় বুলি আউড়াতে। লিখেছেন,
-- 'এজিদ' গল্পগ্রন্থের পরিশিষ্ট থেকে।
" মান্টো অশিক্ষিত। কেননা সে মার্কস পড়েনি, ফ্রয়েডের লেখা চোখেও দেখেনি। হেগেলের নাম শুধু শুনেছে। হ্যাভলক এলিসও শুধু একটা নাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হল তার সমালোচকরা বলে যে সে নাকি এঁদের দ্বারা প্রভাবিত। আমি যদ্দুর জানি, মান্টো অন্য কারোর চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হওয়াকে ঘেন্না করে। তার ধারণা যারা তাকে শিক্ষা দিতে যায় তারা ইডিয়ট ছাড়া কিছু নয়। কেউ অন্য কাউকে পৃথিবী সম্পর্কে শেখাতে যাবে কেন? সে নিজেই আগে ভালো করে দুনিয়াটাকে বুঝুক। মান্টো নিজেকে শেখাতে গিয়ে বা কোনও কিছু নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন সব উদ্ভট কথাবার্তা বলে যে আমি না হেসে পারি না।"মান্টোকে পাঠ করে বারবার মান্টোরই এপিটাফের কথা মনে পড়ে যেটা নিজেই লিখেছেন মান্টো,
--মান্টো কে?
"এখানে সাদত হাসান মান্টোকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর বুকের গভীরে থাকা গল্পের রহস্য এবং মর্মকথা এখানে শায়িত। যেন মাটির নিচের শুয়ে সে ভাবছে, সে বড় গল্পকার নাকি ঈশ্বর!"আসলেই কে বড় গল্পকার?
**তথ্যসূত্রঃ
১. কালো সীমানা-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-জাভেদ হুসেন)
২. ঠান্ডা গোশত-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-কাউসার মাহমুদ)
৩. টোবাটেক সিং ও অন্যান্য গল্প-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-জাফর আলম)
৪. গল্পলেখক ও অশ্লীলতা-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-জাফর আলম)
৫. মান্টো কে?-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-সুদীপ বসু)
১. কালো সীমানা-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-জাভেদ হুসেন)
২. ঠান্ডা গোশত-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-কাউসার মাহমুদ)
৩. টোবাটেক সিং ও অন্যান্য গল্প-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-জাফর আলম)
৪. গল্পলেখক ও অশ্লীলতা-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-জাফর আলম)
৫. মান্টো কে?-সাদত হাসান মান্টো(তর্জমা-সুদীপ বসু)
Comments
Post a Comment