হুমায়ূননামা



(১)
হুমায়ূন আহমেদ বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের এমন একজন লেখক যাকে সঠিক দিক থেকে মূল্যায়ন এখনো শুরু হয় নি।হুমায়ূনের 'অতি সস্তা' 'বাজারি' লেখার মধ্যেও কোনো না কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত থেকেই যায়।সতর্ক পাঠকের সেটা চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা না। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ যে সমালোচনাটা করেন সেটা মূলত একটা প্রজন্মকে রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে বের করে আনার জন্য। অথচ হুমায়ূন আহমেদের অন্তত ডজনখানেক বইতে রাজনীতি নিয়ে বেশ চিন্তাউদ্দীপ্ত কিছু কথা আছে। প্রশ্ন হলো কেন সেটা গ্রহণযোগ্য হলো না বুদ্ধিজীবী বা সমালোচকদের?কারণ হতে পারে হুমায়ূন এই রাজনৈতিক সেন্সগুলোকে স্যাটায়ারের মাধ্যমে,হিউমারের মাধ্যমে পরিবেশন করেছিলেন ,অন্য লেখকেরা যেটা সিরিয়াস লেখনীর মাধ্যমে করে থাকেন। হুমায়ূনের লিখা নিয়ে বলতে গেলে অশ্লীলতার একটা অভিযোগ উঠে আসে। মানুষ মূলত তার নিজের প্রতিচ্ছবি অন্য কারো আয়নায় দেখতে ভয় পায়। তার নিজের যে কলুষতা,অপবিত্রতা সেটাকে হুমায়ূন আঘাত করেছিলেন বলেই হয়তো অশ্লীলতার অভিযোগটি তাঁর উপর এসেছে। মান্টোর ক্ষেত্রেও এ অভিযোগ এসেছিল,আরো বিরাটভাবে।মান্টো জবাব দিয়েছিল,যদি আমার গল্প অশ্লীল হয়,তবে এ সমাজ অশ্লীল,কারণ আমার গল্প এ সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। হুমায়ূন আহমেদের লিখার কিছু জায়গাতে আমরা হালকা করে জাদুবাস্তবতার ছোঁয়াও পাই। যেটা অন্য সকল জায়গায় অচিন্তনীয়,অকল্পনীয় ,সেটা আমাদের মুল্লুকে কি সুন্দর বাস্তবতার মতো কাজ করে সেটা হুমায়ূন বিভিন্ন লিখাতে দেখিয়েছেন। আবার যখন তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখছেন তখন নিরপেক্ষভাবে সত্য তুলে আনার চেষ্টা করছেন। জোছনা ও জননীর গল্পে তিনি বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা এনেছেন ঠিকই।সাথে এনেছেন ভারতীয় সৈন্যদের আত্মত্যাগের কথা।সেই হুমায়ূনই আবার মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের সমালোচনা করেছেন।হুমায়ূনকে আসলে আমরা বাধাধরা একটা ক্যাটেগরিতে ফেলতে গিয়েই ঝামেলার সম্মুখীন হই।কিন্তু হুমায়ূনের গমন ছিলো বিভিন্নদিকে।
(২)
হুমায়ূন আহমেদ জীবিত অবস্থায় যে ধরণের বিখ্যাত ছিলেন,খুব কম লেখকের সৌভাগ্য হয়েছে এ ধরণের জনপ্রিয় হওয়ার। জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত ছিলেন দেখেই হুমায়ূনের মোহ থেকে হয়তোবা বেরিয়ে আসা একটু কঠিন ।কিন্তু হুমায়ূনকে সমালোচনা করতে হলে হুমায়ূনের মোহ থেকে প্রথমে বেরিয়ে আসতে হবে। তাঁর অনেক সমালোচনার জায়গা আছে,দায়বদ্ধতার জায়গা আছে যেগুলো তিনি এড়িয়ে গেছেন। একটা সমালোচনা করে যেতে চাই।সেটা হলো হুমায়ূন বারবার মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে মহান করার চেষ্টা করেছেন। মধ্যবিত্তের শ্রেণিচেতনা খুবই প্রবল। হুমায়ূন নিজে ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন। তাই হয়তো তিনি সে বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি,অথবা চেষ্টা করেন নি। হুমায়ূনকে এসব জায়গায় সমালোচনা করতেই হবে।
হুমায়ূনকে সম্পূর্ণ গ্রহণ কিংবা গ্রহণ না করার প্রশ্নটি নিতান্ত অমূলক। হুমায়ূন পাঠের পর পাঠকের সে স্বাধীনতা আছে সে হুমায়ূনকে গ্রহণ করবে কি করবে না। তবে এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না যে হুমায়ূন অগুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে একেবারে খারিজ করার সুযোগ ও থাকছে না।

(৩)
জীবিত অবস্থায় জনপ্রিয় লেখক হওয়ার সুযোগ ইতিহাসে খুব কম ব্যক্তিই পেয়েছেন। হুমায়ূন তাদের মধ্যে একজন। হুমায়ূনের বইয়ের বাজার ধরার চেষ্টা এবং সেই চেষ্টায় সফল হওয়াটাকে অনেকে ভালো চোখে দেখেন, অনেকে খারাপ চোখে। হুমায়ূন এই বাজার ধরার প্রসেসটার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিন্তু করে ফেলছেন৷ যে বইমেলা একটা সময়ে নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছিল,  হুমায়ূনের ছোঁয়া পেয়ে সেটা আবার জাগ্রত হয়েছিল এটা অস্বীকার করার জো নেই। হুমায়ূনের লিখার সাবলীলতা ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি। তার মধ্যে গল্প বলার একটা প্রবণতা ছিল। সেই গল্প বলাটা কেবল যে তার বইয়ে উঠে এসেছে তা না, তার নাটক সিনেমার মধ্যেও সেই গল্প বলাটা বিদ্যমান। হুমায়ূন 'গণ'কে বুঝতে পেরেছিলেন। জনগণ কী চায় সেই পালসটা বুঝতে পারাটা জরুরি। দ্বিতীয় পয়েন্টে হুমায়ূনের মধ্যবিত্ত প্রেম নিয়ে যে কথাটা বলছি সেখানে আরও কিছু কথা বলা যায়৷ হুমায়ূনের উত্থান মূলতে সত্তুরের দশকের শুরুতে। সত্তুরের দশকের শুরুতে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধকে হুমায়ূন গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন বলে আমার ধারণা। হুমায়ূন নবগঠিত বাংলাদেশ যে মধ্যবিত্তের হাত ধরে এগুনো শুরু করেছে/করবে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। হয়তোবা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই। তাই তিনি সেই ড্রাইভিং ফোর্সটাকে নিয়ে বারবার লিখেছেন। 'বাকের ভাই' কে যখন আমরা দেখি তখন সেই মিডল ক্লাস রেবেল মাথায় আসে। পাড়ার সেই গুন্ডা যে মারামারিও করে আবার যখন বয়স্ক কেউ সামনে পড়ে তাকে সালামও দেয়৷ এই কারণেই বাকের ভাই এন্টি হিরো(ভিলেন না) হয়েও জনগণের মনে জায়গা করে নেয়। যেরকম মানুষকে সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না তার ফাঁসিতেই কেঁপে উঠে সারাদেশ। এইটাই হলো জনগণের সেই পালসটা যেটা হুমায়ূন ধরতে পেরেছিলেন।

(৪)
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়ে অনেকে অনেক উপন্যাস রচনা করেছেন। কোনটা গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা অগুরুত্বপূর্ণ সে নিয়ে আলাপ অগুরুত্বপূর্ণ।  তবে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে যেসব ফিকশন গড়ে উঠছে সেসব জায়গায় লেখক মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা কীভাবে দিচ্ছেন সেটা বুঝতে পারাটা খুব জরুরী। শহিদুল জহিরকে বা ইলিয়াসকে যখন আপনি পড়ছেন তখন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভিন্ন একটা দিক আপনি পাচ্ছেন। কোনো রগরগে বর্ণনা এসব লিখায় আপনি পাচ্ছেন না। উপরন্তু সামাজিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবটা আপনি এসব লিখায় দেখতে পাচ্ছেন। জহির পড়ে আপনি দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে সামাজিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা সমস্যায় পড়ছেন, রাজাকার পুনর্বাসিত হচ্ছে। হুমায়ূনের লিখায়ও৷ এ ধরনের প্রভাব আপনি পাবেন। জোছনা ও জননীর গল্পের কথা আগেই বলেছি। এ উপন্যাসের বয়ানে একজন মওলানা থাকেন। স্বাভাবিকভাবে যিনি আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়েন। পাকিস্তানিরা ধর্মের দোহাই দিচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে মানুষ মারছে। সেখান থেকে তিনি নিজের আইডেন্টিটি গঠন করছেন। তিনি স্বাধীনতাকে গভীরভাবে অনুভব করছেন। তাই তিনি একটা মুহুর্তের জন্য ধর্মীয় আইডেন্টিটিকে পাশে রেখে(কিংবা সাথে রেখেই) নিজের স্বাধীনতাকামী আইডেন্টিটিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। হুমায়ূনের গল্পের ক্যারেক্টার পোট্রেয়াল এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ। হিমু যতটা না গুরুত্বপূর্ণ কোনো গল্পের মধ্যে হিমুর চরিত্রকে কীভাবে হুমায়ূন বিকশিত করছেন সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে হুমায়ূনের দেখা মুক্তিযুদ্ধকে অনেকের অরাজনৈতিক এবং নিরপেক্ষ মনে হয়।  কিন্তু হুমায়ূনের গল্পের মুক্তিযুদ্ধ আসলে হাইলি পলিটিক্যাল। সেই পলিটিক্সটা তার চরিত্র বর্ণনার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। 

Comments