মোহাম্মদ আজমের হুমায়ূনভাবনা
বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ একইসাথে জনপ্রিয় লেখক আর বাজারি লেখক এই দুই
খেতাব পাওয়া এক লোক। জীবিত অবস্থায় সমসাময়িক সময়ের কোনো সাহিত্যিক এ ধরনের
জনপ্রিয়তা পায় নি বাংলাদেশে। আশ্চর্য রকমের অবাক করা বিষয় হলো, হুমায়ূন
আহমেদকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তেমন একটা দেখা যায় না। আনন্দবাজারে ‘সম্রাট
হুমায়ূন’ শিরোনামে সমরেশ মজুমদার যা করেছেন তা মূলত এক প্রকার স্মৃতিচারণ।
সেই স্মৃতিচারণে হুমায়ূনের মাহাত্ম্য পাওয়া যাবে, কিন্তু হুমায়ূনের
সাহিত্যের সূক্ষ্মতা-স্থূলতা পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর
অবস্থা আরো খারাপ। এমন অবস্থায় মোহাম্মদ আজমের লিখার শরণাপন্ন হওয়াটা যেন
বড় এক প্রাপ্তি। বাংলাদেশে হয়তো আজমই প্রথম হুমায়ূনকে নিয়ে ক্রিটিকাল
আলোচনা শুরু করছেন। হুমায়ূনকে ব্যবচ্ছেদ করছেন আজমই। হুমায়ূন সাহিত্যকে
পাঠের যে পদ্ধতি সেটা বাতলে দিচ্ছেন আজম। পরবর্তীতে যারাই হুমায়ূনকে নিয়ে
গবেষণা করবেন তাদের জন্য আজম পথিকৃৎ স্বরূপ। হুমায়ূনকে নিয়ে আজমের বেশ
অনেকগুলো ক্রিটিকাল আলোচনা আছে। সে সব আলোচনার প্রেক্ষিতেই হুমায়ূন
সাহিত্যকে পর্যালোচনা করার প্রয়াস এ আলাপে থাকবে।
(১)
হুমায়ূন-সাহিত্য সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটা জাগে সেটা হলো, শুরু থেকেই হুমায়ূনের লিখার প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নটার সোজাসাপটা জবাব হতে পারে ভাষাগত সারল্যের কারণে। ভাষাগত সারল্য আসলে কিভাবে কাজ করছে মূলত এ আলাপ করছেন আজম। হুমায়ূনের বাক্যগঠন দেখলে দেখা যাচ্ছে হুমায়ূন আসলে খুব ছোট ছোট সরল বাক্য লিখছেন। বিনয় সরকারকে প্রাসঙ্গিক করে আজম বলছেন , ছোট-সরল বাক্য হচ্ছে ‘খাঁটি বাংলা’র স্বভাব। হুমায়ূনের লেখায় এ খাঁটি বাংলা বাক্যই প্রাধান্য পাচ্ছে। হুমায়ূনকে একইসাথে ঘটনা পরম্পরা, বাক্যের কার্যকারণ সম্পর্ক আর গতি এই তিনকে রক্ষা করতে হচ্ছে। এই তিন নিশ্চিত করতে পারাটা হুমায়ূন সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ট্য,যেখানে সারল্য প্রথম ধাপ মাত্র। বাক্যগত গঠন ছাড়াও হুমায়ূন সাহিত্য মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আরো কারণ আছে। হুমায়ূন কাহিনী লিখতেন না, বলতেন আসলে। হুমায়ূনের গল্প তাই হয়ে উঠছে গভীর সংলাপময়। সেই সংলাপে চরিত্রটি পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়ে যায়। হুমায়ূন যে কাজটা করছেন সেটা অনেকটা মুখের ভাষাকে লিখিত ভাষায় অনুবাদ করছেন। অতএব এ কাজটার জন্যও হুমায়ূন প্রশংসার দাবীদার। গল্প যখন বলা হয়, সে গল্পে থাকে আন্তরিকতা,সম্মোহন। আন্তরিকতা-সম্মোহনসমেত গল্প বলার ভাষাটাকে লিখিত ভাষায় অনুবাদ করা জটিল কাজই বটে। হুমায়ূন লিখতে মুখের বাংলায়। আজম এ জায়গাতেই ‘গল্প-বলিয়ে’ শরৎচন্দ্রের সাথে ‘গল্প-বলিয়ে’ হুমায়ূনের ফারাক খুঁজে পাচ্ছেন। যেদিকে হুমায়ূন লিখছে মুখের বাংলায়, সেখানে শরত লিখছেন সাহিত্যিক বাংলায়। চরিত্রের বাস্তবতা আর লেখকের গল্প লেখন এই দুইয়ের মাঝে যে দূরত্বটা থাকে, সে দূরত্বকেই ঘুচিয়ে দিয়েছেন হুমায়ূন।
হুমায়ূন যখন নিজ বয়ানে কিছু বলছেন গল্প বা উপন্যাসে সেই বয়ানটাও সংলাপময়। সংলাপের মধ্যেই হুমায়ূন গল্পের চারিত্রিক বর্ণনা করছেন। চরিত্রের যে ভাব-স্বভাব সেটাকে তিনিই বর্ণনা করছেন , এজন্য চরিত্রের স্বর হয়ে যাচ্ছে খুবই স্পষ্ট। এ বিষয়টা নাটক-সিনেমায় যখন হুমায়ূনের গল্প ব্যবহার করা হচ্ছে তখনই বোঝা যায়। কারণ নাটক-সিনেমায় গল্প থেকে সংলাপের পরিবর্তন তেমন একটা বেশি করতে হচ্ছে না। আজমের এই অব্জার্ভেশন-এনালাইসিসটা খুবই ইন্টারেস্টিং। আমরা যখন হুমায়ূনের সিনেমাগুলো দেখছি , তার বই ও পড়ছি একইসাথে আমরা কিন্তু দুই জায়গার চরিত্রের সংলাপের তেমন একটা তফাত খুঁজে পাব না। সেটা ‘আগুনের পরশমণি’ হোক, সেটা ‘শ্যামল ছায়া’ হোক অথবা ‘দারুচিনি দ্বীপ’। মুখের ভাষার দরদটাকে অনুবাদ করে ফেলছেন দেখেই ‘কোথাও কেউ নেই’ তে বাকের ভাইয়ের ফাঁসিতে আমাদের মন ঠিক ততটাই খারাপ হচ্ছে যতটা খারাপ নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দেখে আমাদের হয়েছে। একইভাবে কমিক টাইমিংগুলোও আমাদের কাছে একইভাবে ধরা দিচ্ছে। আর ঠিক এ কারণেই হুমায়ূনের নাটক-সিনেমাও সাহিত্যিক একটা গুরুত্ব পেয়ে যায়। সেলুলয়েড-কাগজ মিলেমিশে একত্রেই হুমায়ূনকে জনপ্রিয় করে তোলে।
(২)
যেকোনো সাহিত্যিকের সাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রে ন্যারেটিভ একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ লেখক কিভাবে কোন চরিত্রকে দেখছেন , কোন চরিত্রের প্রতি লেখক নিজের সিমপ্যাথি ঢালছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। গল্প-উপন্যাসের বর্ণনাকালে দেখা যায়, সবসময় লেখকের পক্ষপাতহীনতা দেখা যায় না। লেখক একটা পক্ষ নিয়েই ফেলেন। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সিমপ্যাথি বা সহানুভূতি। হুমায়ূনের ছিল এই দুই অস্ত্র। আজম দেখাচ্ছেন শরত-রবীন্দ্রনাথে সহানুভূতিটা প্রকাশ পাচ্ছে , আবার মানিক-ইলিয়াসে পাচ্ছে না। আবার মানিক-ইলিয়াস পক্ষপাতদুষ্ট! মানিক-ইলিয়াস দুইজনই বড় লেখক হওয়ায় এ প্রশ্নের দায় থেকে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। কারণ , তাঁদের লেখার অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ সেখানে মুখ্য হয়ে উঠে। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে , হুমায়ূন প্রত্যেকটা চরিত্রের প্রতিই তাঁর সিম্প্যাথি বা সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। যার কারণে একজন ভয়ানক খুনিও জেলে বসে ‘মুরগির সালুন দিয়ে ভাত’ খাওয়ার ইচ্ছা পোষণের সময়টিতে হুমায়ূনের সিম্প্যাথি পাচ্ছেন। আজম বলছেন, এই সহানুভূতির বা একাত্ম হওয়ার গুণটি তাৎপর্য পাচ্ছে এই জায়গায় যে, হুমায়ূন আসলে সব চরিত্রেই সমানভাবে উপস্থিত থাকতে পারছেন। হুমায়ূন সাধারণত বিপুল চরিত্র নিয়ে কাজ করেছেন খুব কম। তাই বিভিন্ন চরিত্রের আলাদা আলাদা যে টোন , একইসাথে সেগুলো শ্রুত হওয়ার জন্য তাঁর একাত্ম হওয়ার জায়গাটিতে একটু কম পরিশ্রম করতে হয়েছে। অবশ্য ‘মধ্যাহ্ন’ , ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ , ‘মাতাল হাওয়া’ , ‘দেয়াল’ এসব ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষণীয়।
সহানুভূতি ছাড়াও হুমায়ূন অনন্য হয়ে উঠছেন চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতহীনতা দেখানোর ক্ষেত্রে। আসলে একদিক থেকে দেখতে গেলে এটা হুমায়ূনের স্বভাবজাত যে বৈশিষ্ট্য , সেটাকেই প্রকাশ করে। হুমায়ূন কোনো চরিত্রকে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো পর্যন্ত বিস্তৃত করেন নি। অর্থাৎ একদিক থেকে বলতে গেলে বলা যায় হুমায়ূন আসলে চান নি চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর যে মত সেটা পাঠকের মনে গেঁথে যাক। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব তাই তিনি পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিচ্ছেন। এখানে হুমায়ূন যে শুধু চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা নিয়ে খেলছেন তা নয়, হুমায়ূন আসলে পাঠকের মনস্তত্ত্ব নিয়েও খেলছেন। সংকটের সময়ও কিন্তু তিনি চরিত্রকে দীর্ঘায়িত করছেন না। সংকটের দায়টুকু হুমায়ূন নিতে নারাজ ছিলেন। তাই হুমায়ূন হয়ে উঠছেন পক্ষপাতহীন। আজম আরেকটা বিষয় বলছেন, যদিওবা খুব সংক্ষেপে, কিন্তু খুবই গুরুত্বপুর্ণভাবে যে, হুমায়ূনের বর্ণনা আসলে ফটোগ্রাফিক। দেখানো বিষয়টা হুমায়ূনসাহিত্যের অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য। হুমায়ূন একটা ফটোফ্রেমের মতো গল্পটাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন। ফটোগ্রাফার যেমন দায় নেয় না , ছবিটি কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে বা কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটার, হুমায়ূনও একই। হুমায়ূনও ঘটনা তুলে ধরে সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়টি আর নিজের ঘাড়ে তুলে নিচ্ছেন না। হুমায়ূন সাহিত্যের সারল্য, গভীরতা নিয়ে তাই আজম বলছেন,
(৩)
আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের মূল যে সমস্যাটি দুনিয়াজুড়ে লক্ষ্য করা যায় সেটা হলো, জনবিচ্ছিন্নতা। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই জনবিচ্ছিন্নতা যেন প্রয়োজনীয় এক উপকরণ হয়ে উঠেছিল। হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা তাই সাহিত্য আলোচক-সমালোচকদের মনে সংশয় তৈরি করেছিল। আজম বাংলা সাহিত্য ,ভাষারীতি, ব্যকরণ-এসবের ক্ষেত্রে একাডেমিক মানুষ। তাই একাডেমিকভাবে হুমায়ূন পাঠের জায়গাটি সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারেন। ঠিক এজন্যই তিনি জনপ্রিয়তার ব্যাপারে সংশয়ের কারণে হুমায়ূন কিভাবে একাডেমিকভাবে খারিজ হয়ে যাচ্ছে সেটা বলছেন। ভাটি অঞ্চল নিয়ে থিসিস করা বাংলার ছাত্র হুমায়ূনের ‘ফেরা’ উপন্যাসটি ‘সিরিয়াস’ টেক্সট হিসেবে পড়ছে না অথবা মধ্যবিত্ত নিয়ে কাজ করা কেউ যে হুমায়ূন নিয়ে কাজ করছে না সেটা আজম দেখাচ্ছেন। হুমায়ূনের ‘আমার আছে জল’ উপন্যাস কিংবা উপন্যাস থেকে ছবি নির্মাণের বিষয়টিতে আজম খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যালোচনা দিচ্ছেন এভাবে,
(৪)
হুমায়ূনের ‘মানুষ’ সংক্রান্ত আলাপটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। হুমায়ূনের মানুষ অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মানুষ হতে গিয়ে তার থেকে পৃথক হয়ে উঠছে কিভাবে সে অংশটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজম এখানে হুমায়ূন আর রবীন্দ্রনাথের মানুষের মধ্যে পার্থক্য দেখাচ্ছেন দুটি জায়গায়। প্রথমত , রবীন্দ্রনাথ বাহ্যপরিস্থিতির সাথে মানবসম্পর্ককে একেবারেই আমলে আনেন না। বিপরীতে হুমায়ূন সেখানে বাহ্য পরিস্থিতিকে আমলে আনছেন, এবং খুব ভয়াবহভাবে দেখা যায় ছোটোখাটো প্রায়-গৌণ প্রভাববকের কারণেই চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। আর দ্বিতীয় যে পার্থক্যটি আজম করছেন সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের ‘মানবিকতা’ হচ্ছে ‘মহৎ’ গুণ। সেটা অন্তর্নিহিত বা অর্জিত যেকোনোভাবেই হতে পারে। অর্থাৎ সে গুণের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি/বৈপরীত্য এক বিপরীত মানুষ তৈরী করে। এ জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথের মানুষ ‘ভালো’ আর ‘খারাপে’র বাইনারিতে পড়ে যায়। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি হয় ভালো হবে, যার মধ্যে মানবিকতা থাকবে, নাহয় সে হয়ে যাবে খারাপ। হুমায়ূন এ জায়গায় এই বাইনারি ধারণা থেকে বের হয়ে আসছেন। কারণ হুমায়ূনের ‘মানবিকতা’ মানুষের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। অতএব , সকল মানুষের মধ্যেই কম-বেশি এটি থাকবে। পারিপার্শ্বিকতার কারণে এর কোনোটি লোপ পায়, কোনোটি বিকৃত হয়ে যায়। কিন্তু কখনো সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে যায় না। অর্থাৎ হুমায়ূন ‘এবসলিউট খারাপ মানুষ’ এর ধারণাটিকে নাকচ করে দিচ্ছেন এখানে।
হুমায়ূনের মানুষ সংক্রান্ত এ ভাবনাটি আমাদের খুব সুন্দরভাবে একটি দিকে পরিচালিত করবে। আমরা প্রথমদিকে হুমায়ূনের রচনার সহানুভূতি আর পক্ষপাতহীনতার যে কথা বলছিলাম , সেটাই এখানে ধরা পড়বে। রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ভালো-মন্দ জোড়ের যে বাইনারি তৈরি করছেন সে বাইনারি মূলত লেখককে চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে হুমায়ূন যেহেতু এই বাইনারি থেকে চরিত্রকে মুক্ত রাখছেন তাই দেখা যাচ্ছে ‘আপাত’ মন্দ বা সমাজে ‘অন্যায্য’ লোকটিও হুমায়ূনের সহানুভূতি পাচ্ছে। এ সহানুভূতির কারণ এমন নয় যে হুমায়ূন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার একটি কাউন্টার-ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। এটার কারণ অনেকটা এরকম যে মন্দের ভেতর যে ‘মানবীয় গুণাবলী’ সুপ্ত অবস্থায় আছে সেটিকে হুমায়ূন অবলোকন করছেন, প্রধান্য দিচ্ছেন। এদিক দিয়ে হুমায়ূনের মানুষ একটি আলাদা আলাপের দাবীদার অবশ্যই।
(৫)
হুমায়ূন সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় যে দ্বিধা সেটা হলো হুমায়ূন পাঠের সমস্যা। হুমায়ূন পাঠকে আজম বেশ কঠিন বলেই আখ্যায়িত করছেন। সত্যিকার অর্থেই তাই। হুমায়ূন পাঠ যে দূরহ হয়ে উঠে তার জন্য দায়ী খোদ হুমায়ূনই। হুমায়ূন আক্ষরিক অর্থেই বাজারি লেখক। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তিনি লিখছেন। এ বাজার যে শিল্প-সাহিত্যের বাজার তা নয়। বরং সেটা ছিল ক্রেতার বাজার। আর তাই হুমায়ূনের লিখায় হুমায়ূনকে আবিষ্কার করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রায়শই সিরিজ লিখেছেন। ক্রেতা-প্রকাশকের চাহিদা মাথায় রেখে। আর এসব লেখাতে আমরা লক্ষ্য করি চরিত্র ও ভাব-ভঙ্গির পুনরাবৃত্তি। অবশ্য এটা ঠিক হয়েছে কি হয় নি সে আলাপ সম্পূর্ণ গৌণ। কিন্তু লেখালেখির ক্ষেত্রে লেখা নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ যেমন একদিকে আর একদিকে পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শুধু তাই নয়। হুমায়ূন পাঠের সবচেয়ে বড় সমস্যা হুমায়ূনকে ক্যাটেগরাইজড করা যায় না। অন্যান্য লেখক যেভাবে ক্যাটেগরির মধ্যে এঁটে যান, হুমায়ূন সেভাবে আঁটেন না। বরং হুমায়ূনকে পাঠ করতে গেলে নতুন করে একটা ক্যাটেগরি তৈরি করে নিতে হয়। পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে সে কাজটা বেশ কঠিন একটা কাজই। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে যথাযথ সমালোচনা গড়ে না উঠার পেছনে একটা চলিষ্ণু সমালোচনাধারা না থাকাকে দায়ী করছেন আজম। হুমায়ূনের আরো একটি সমস্যা হলো, ‘আধুনিক’ শিল্পে যে শরীরী-প্রতিভার মহিমা আছে সেটা তাঁর মধ্যে পাওয়া যায় না। একজন শিল্পীকে প্রথমে শিল্প তৈরী করতে হয়, আর এর পরে পরিশ্রম করে সে শিল্পের চিহ্ন মুছতে হয় রচনা থেকে। এ দুটিই পরিশ্রমের কাজ। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কাজটি প্রথম ধাপেই হয়ে যায়। প্রথম ধাপেই তাঁর রচনা থেকে শিল্পের চিহ্ন মুছে যায়। তিরিশের দশকে শরীরী-প্রতিভার মহিমায় যে বাজার গড়ে উঠেছিল সে বাজারে হুমায়ূন আসলেই গৌণ ছিলেন শিল্পের এরকম ব্যবহারে।
হুমায়ূন বয়ান নিয়ে বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তাঁর রচনায়। বিভিন্ন ধরণের প্রচলিত বয়ানভঙ্গি তিনি রচনায় ব্যবহার করেছেন। সফল হয়েছেন কি ব্যর্থ সেটা পরের বিষয়। আজমের হুমায়ূন সংক্রান্ত আলাপগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এ জায়গাতেই। হুমায়ূন আলোচনা-সমালোচনার যে ধারা আজম তৈরি করে দিচ্ছেন সে ধারার প্রধান গুরুত্বটা হলো হুমায়ূন পঠন-পদ্ধতি। হুমায়ূনকে সঠিকভাবে পাঠ করতে না পারলে হুমায়ূনের সাহিত্যের ক্যারিশমা-বুজরকি সহজে চোখে ধরা পড়বে না। হুমায়ূন হয় পূজনীয় হয়ে উঠবেন, নাহয় নিন্দনীয়। হুমায়ূনকে গ্রহন-বর্জনের প্রশ্ন তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। আজমের এ প্রয়াসটিকে তাই সাধুবাদ জানাতেই হয়। আর আজমের দেখানো পথ , চলিষ্ণু সমালোচনা ধারা তৈরির ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকাই পালন করবে।
তথ্যসূত্রঃ
১) হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে নারীমূর্তি ও সংসারচিত্র- মোহাম্মদ আজম
২) হুমায়ূন পাঠের সমস্যা- মোহাম্মদ আজম
৩) হুমায়ূন আহমেদের একটি গল্প ‘পাপ’- মোহাম্মদ আজম
৪) হুমায়ূন আহমেদের ভাষাঃ সারল্য বনাম গভীরতা-মোহাম্মদ আজম
৫) হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘এই বসন্তে’ ঃ সামষ্টিক প্রতিরোধ-প্রবণতায় ব্যক্তির সক্রিয়তা প্রসঙ্গে-মোহাম্মদ আজম।
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট |
(১)
হুমায়ূন-সাহিত্য সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটা জাগে সেটা হলো, শুরু থেকেই হুমায়ূনের লিখার প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নটার সোজাসাপটা জবাব হতে পারে ভাষাগত সারল্যের কারণে। ভাষাগত সারল্য আসলে কিভাবে কাজ করছে মূলত এ আলাপ করছেন আজম। হুমায়ূনের বাক্যগঠন দেখলে দেখা যাচ্ছে হুমায়ূন আসলে খুব ছোট ছোট সরল বাক্য লিখছেন। বিনয় সরকারকে প্রাসঙ্গিক করে আজম বলছেন , ছোট-সরল বাক্য হচ্ছে ‘খাঁটি বাংলা’র স্বভাব। হুমায়ূনের লেখায় এ খাঁটি বাংলা বাক্যই প্রাধান্য পাচ্ছে। হুমায়ূনকে একইসাথে ঘটনা পরম্পরা, বাক্যের কার্যকারণ সম্পর্ক আর গতি এই তিনকে রক্ষা করতে হচ্ছে। এই তিন নিশ্চিত করতে পারাটা হুমায়ূন সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ট্য,যেখানে সারল্য প্রথম ধাপ মাত্র। বাক্যগত গঠন ছাড়াও হুমায়ূন সাহিত্য মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আরো কারণ আছে। হুমায়ূন কাহিনী লিখতেন না, বলতেন আসলে। হুমায়ূনের গল্প তাই হয়ে উঠছে গভীর সংলাপময়। সেই সংলাপে চরিত্রটি পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়ে যায়। হুমায়ূন যে কাজটা করছেন সেটা অনেকটা মুখের ভাষাকে লিখিত ভাষায় অনুবাদ করছেন। অতএব এ কাজটার জন্যও হুমায়ূন প্রশংসার দাবীদার। গল্প যখন বলা হয়, সে গল্পে থাকে আন্তরিকতা,সম্মোহন। আন্তরিকতা-সম্মোহনসমেত গল্প বলার ভাষাটাকে লিখিত ভাষায় অনুবাদ করা জটিল কাজই বটে। হুমায়ূন লিখতে মুখের বাংলায়। আজম এ জায়গাতেই ‘গল্প-বলিয়ে’ শরৎচন্দ্রের সাথে ‘গল্প-বলিয়ে’ হুমায়ূনের ফারাক খুঁজে পাচ্ছেন। যেদিকে হুমায়ূন লিখছে মুখের বাংলায়, সেখানে শরত লিখছেন সাহিত্যিক বাংলায়। চরিত্রের বাস্তবতা আর লেখকের গল্প লেখন এই দুইয়ের মাঝে যে দূরত্বটা থাকে, সে দূরত্বকেই ঘুচিয়ে দিয়েছেন হুমায়ূন।
হুমায়ূন যখন নিজ বয়ানে কিছু বলছেন গল্প বা উপন্যাসে সেই বয়ানটাও সংলাপময়। সংলাপের মধ্যেই হুমায়ূন গল্পের চারিত্রিক বর্ণনা করছেন। চরিত্রের যে ভাব-স্বভাব সেটাকে তিনিই বর্ণনা করছেন , এজন্য চরিত্রের স্বর হয়ে যাচ্ছে খুবই স্পষ্ট। এ বিষয়টা নাটক-সিনেমায় যখন হুমায়ূনের গল্প ব্যবহার করা হচ্ছে তখনই বোঝা যায়। কারণ নাটক-সিনেমায় গল্প থেকে সংলাপের পরিবর্তন তেমন একটা বেশি করতে হচ্ছে না। আজমের এই অব্জার্ভেশন-এনালাইসিসটা খুবই ইন্টারেস্টিং। আমরা যখন হুমায়ূনের সিনেমাগুলো দেখছি , তার বই ও পড়ছি একইসাথে আমরা কিন্তু দুই জায়গার চরিত্রের সংলাপের তেমন একটা তফাত খুঁজে পাব না। সেটা ‘আগুনের পরশমণি’ হোক, সেটা ‘শ্যামল ছায়া’ হোক অথবা ‘দারুচিনি দ্বীপ’। মুখের ভাষার দরদটাকে অনুবাদ করে ফেলছেন দেখেই ‘কোথাও কেউ নেই’ তে বাকের ভাইয়ের ফাঁসিতে আমাদের মন ঠিক ততটাই খারাপ হচ্ছে যতটা খারাপ নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দেখে আমাদের হয়েছে। একইভাবে কমিক টাইমিংগুলোও আমাদের কাছে একইভাবে ধরা দিচ্ছে। আর ঠিক এ কারণেই হুমায়ূনের নাটক-সিনেমাও সাহিত্যিক একটা গুরুত্ব পেয়ে যায়। সেলুলয়েড-কাগজ মিলেমিশে একত্রেই হুমায়ূনকে জনপ্রিয় করে তোলে।
(২)
যেকোনো সাহিত্যিকের সাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রে ন্যারেটিভ একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ লেখক কিভাবে কোন চরিত্রকে দেখছেন , কোন চরিত্রের প্রতি লেখক নিজের সিমপ্যাথি ঢালছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। গল্প-উপন্যাসের বর্ণনাকালে দেখা যায়, সবসময় লেখকের পক্ষপাতহীনতা দেখা যায় না। লেখক একটা পক্ষ নিয়েই ফেলেন। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সিমপ্যাথি বা সহানুভূতি। হুমায়ূনের ছিল এই দুই অস্ত্র। আজম দেখাচ্ছেন শরত-রবীন্দ্রনাথে সহানুভূতিটা প্রকাশ পাচ্ছে , আবার মানিক-ইলিয়াসে পাচ্ছে না। আবার মানিক-ইলিয়াস পক্ষপাতদুষ্ট! মানিক-ইলিয়াস দুইজনই বড় লেখক হওয়ায় এ প্রশ্নের দায় থেকে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। কারণ , তাঁদের লেখার অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ সেখানে মুখ্য হয়ে উঠে। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে , হুমায়ূন প্রত্যেকটা চরিত্রের প্রতিই তাঁর সিম্প্যাথি বা সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। যার কারণে একজন ভয়ানক খুনিও জেলে বসে ‘মুরগির সালুন দিয়ে ভাত’ খাওয়ার ইচ্ছা পোষণের সময়টিতে হুমায়ূনের সিম্প্যাথি পাচ্ছেন। আজম বলছেন, এই সহানুভূতির বা একাত্ম হওয়ার গুণটি তাৎপর্য পাচ্ছে এই জায়গায় যে, হুমায়ূন আসলে সব চরিত্রেই সমানভাবে উপস্থিত থাকতে পারছেন। হুমায়ূন সাধারণত বিপুল চরিত্র নিয়ে কাজ করেছেন খুব কম। তাই বিভিন্ন চরিত্রের আলাদা আলাদা যে টোন , একইসাথে সেগুলো শ্রুত হওয়ার জন্য তাঁর একাত্ম হওয়ার জায়গাটিতে একটু কম পরিশ্রম করতে হয়েছে। অবশ্য ‘মধ্যাহ্ন’ , ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ , ‘মাতাল হাওয়া’ , ‘দেয়াল’ এসব ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষণীয়।
সহানুভূতি ছাড়াও হুমায়ূন অনন্য হয়ে উঠছেন চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতহীনতা দেখানোর ক্ষেত্রে। আসলে একদিক থেকে দেখতে গেলে এটা হুমায়ূনের স্বভাবজাত যে বৈশিষ্ট্য , সেটাকেই প্রকাশ করে। হুমায়ূন কোনো চরিত্রকে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো পর্যন্ত বিস্তৃত করেন নি। অর্থাৎ একদিক থেকে বলতে গেলে বলা যায় হুমায়ূন আসলে চান নি চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর যে মত সেটা পাঠকের মনে গেঁথে যাক। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব তাই তিনি পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিচ্ছেন। এখানে হুমায়ূন যে শুধু চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা নিয়ে খেলছেন তা নয়, হুমায়ূন আসলে পাঠকের মনস্তত্ত্ব নিয়েও খেলছেন। সংকটের সময়ও কিন্তু তিনি চরিত্রকে দীর্ঘায়িত করছেন না। সংকটের দায়টুকু হুমায়ূন নিতে নারাজ ছিলেন। তাই হুমায়ূন হয়ে উঠছেন পক্ষপাতহীন। আজম আরেকটা বিষয় বলছেন, যদিওবা খুব সংক্ষেপে, কিন্তু খুবই গুরুত্বপুর্ণভাবে যে, হুমায়ূনের বর্ণনা আসলে ফটোগ্রাফিক। দেখানো বিষয়টা হুমায়ূনসাহিত্যের অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য। হুমায়ূন একটা ফটোফ্রেমের মতো গল্পটাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতেন। ফটোগ্রাফার যেমন দায় নেয় না , ছবিটি কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে বা কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটার, হুমায়ূনও একই। হুমায়ূনও ঘটনা তুলে ধরে সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়টি আর নিজের ঘাড়ে তুলে নিচ্ছেন না। হুমায়ূন সাহিত্যের সারল্য, গভীরতা নিয়ে তাই আজম বলছেন,
“ হুমায়ূনের সাহিত্য খুব গভীর অর্থে ‘লিবারাল’। সহানুভূতিশীল, কিন্তু নিরাসক্ত। তাঁর রচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাঠের জন্য দরকার অন্যতর নান্দনিক বোধ। দরকার সারল্যের মধ্যে গভীরতা আবিষ্কারের সামর্থ্য।”
(৩)
আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের মূল যে সমস্যাটি দুনিয়াজুড়ে লক্ষ্য করা যায় সেটা হলো, জনবিচ্ছিন্নতা। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সেই জনবিচ্ছিন্নতা যেন প্রয়োজনীয় এক উপকরণ হয়ে উঠেছিল। হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা তাই সাহিত্য আলোচক-সমালোচকদের মনে সংশয় তৈরি করেছিল। আজম বাংলা সাহিত্য ,ভাষারীতি, ব্যকরণ-এসবের ক্ষেত্রে একাডেমিক মানুষ। তাই একাডেমিকভাবে হুমায়ূন পাঠের জায়গাটি সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারেন। ঠিক এজন্যই তিনি জনপ্রিয়তার ব্যাপারে সংশয়ের কারণে হুমায়ূন কিভাবে একাডেমিকভাবে খারিজ হয়ে যাচ্ছে সেটা বলছেন। ভাটি অঞ্চল নিয়ে থিসিস করা বাংলার ছাত্র হুমায়ূনের ‘ফেরা’ উপন্যাসটি ‘সিরিয়াস’ টেক্সট হিসেবে পড়ছে না অথবা মধ্যবিত্ত নিয়ে কাজ করা কেউ যে হুমায়ূন নিয়ে কাজ করছে না সেটা আজম দেখাচ্ছেন। হুমায়ূনের ‘আমার আছে জল’ উপন্যাস কিংবা উপন্যাস থেকে ছবি নির্মাণের বিষয়টিতে আজম খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যালোচনা দিচ্ছেন এভাবে,
“হুমায়ূন এরকমই করেন। মানুষের কর্ম ও আচরণকে ইডিওলজির নিয়ন্ত্রণ থেকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখেন। পরিবেশ বা শ্রেণিভিত্তি তাঁর লেখায় যথেষ্ট গুরুত্ব পায় কিন্তু কল্লোলীয়দের লেখায় মানুষকে প্রতিবেশের পুতুল বানিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে রেওয়াজ দেখা গেছে , হুমায়ূনের লেখায় তেমনটা প্রায় কখনোই ঘটে না। নাগরিক মানুষ বা পরিবার বা জনপরিসর আঁকার কালে ‘নগর জীবনে’র বিশ্বজনীন ধারণাকে তিনি একেবারেই প্রশ্রয় দেন না। এ কারণেই তাঁর ঢাকা অনেক বেশি ‘স্বাভাবিক’ ঢাকা। এ কারণেই তাঁর লেখায় এত গুরুত্বপূর্ণ থেকে যায়। মানুষের ‘স্বাভাবিক’ আবেগ-অনুভূতি এতটা পরিসর পেতে পারে।”হুমায়ূনের রচনা বেশ গভীর অর্থেই পারিবারিক। বিবাহ-সম্পর্ক আর প্রেম-সম্পর্কে যে তাৎপর্য আর যে সূক্ষ্ম ফল্টলাইন আছে সেটা হুমায়ূন বেশ ভালোভাবেই জানতেন। আর তাই এই দুই সম্পর্ক হয়ে উঠছে হুমায়ূনের রচনায় পারিবারিক। হুমায়ূনের রচনায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একেবারে নেই বললেই চলে। তবে হুমায়ূনের রচনার ক্ষেত্রে একটা কথা যেটা বলতেই হয় সেটা হলো, হুমায়ূনের প্রেম বেশিরভাগ সময়েই নারীর প্রেম রূপে এসেছে। কিছু কিছু উপন্যাস যেমন ‘আমার আছে জল’ সর্বাঙ্গীনভাবেই প্রেমের উপন্যাস। এর আগেরও কিছু না, পরেরও কিছু না। হুমায়ূনের নারী-চরিত্র রূপায়নের জায়গাটি নিয়ে কিছুটা আলাপ করা যায় এ ক্ষেত্রে। হুমায়ূন নারী চরিত্র যখন তৈরী করছেন ,তখন আমরা দেখব সেসব নারী চরিত্র গুণের চেয়ে রূপের যে বর্ণনা সেটি বেশি লক্ষ্যণীয়। আবার পুরুষ চরিত্রের ক্ষেত্রে হুমায়ূন বলছেন ‘রূপবান পুরুষ প্রকৃতি পছন্দ করে না।’ রূপ আর গুণের বাইনারি যদি আমরা চিন্তা করি , তবে সেখানে হুমায়ূন নারীকে প্রদান করছেন রূপ আর পুরুষকে গুণ। হুমায়ূনের এ ব্যাপারটি অবশ্য বেশ লিঙ্গবাদী একটা ব্যাপার। হুমায়ূন নারী-পুরুষকে সবসময়ই আলাদা করে দেখছেন। তার কারণ হয়তোবা এমন যে তাঁর প্রায় গল্পের উপজীব্য হয়ে উঠে নারী পুরুষের প্রেম। অবশ্য হুমায়ূনের প্রেম সংক্রান্ত আজমের আলাপটি এখানে করে রাখা ভালো। হুমায়ূনের প্রেমকে ক্লাসিক সাহিত্যিক বা কথাসাহিত্যিকদেরর প্রেম থেকে আজম আলাদা করছেন। আজম বলছেন ,
“ প্রেম সম্পর্ককে তিনি রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের মতো ড্রয়িংরুমের সক্রিয়তায় পরিণত করছেন না, বা সুনীল-মিলনের মতো ব্যক্তিগত সম্পর্কে সীমিত রাখেন না। পারিবারিক সম্পর্কের যাবতীয় বাস্তবতা বা টেনশনের সাথেই মিলিয়ে দেন। ঘরের পরিসরকেই প্রেমের পরিসর হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেন। ”
(৪)
হুমায়ূনের ‘মানুষ’ সংক্রান্ত আলাপটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলাপ। হুমায়ূনের মানুষ অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মানুষ হতে গিয়ে তার থেকে পৃথক হয়ে উঠছে কিভাবে সে অংশটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজম এখানে হুমায়ূন আর রবীন্দ্রনাথের মানুষের মধ্যে পার্থক্য দেখাচ্ছেন দুটি জায়গায়। প্রথমত , রবীন্দ্রনাথ বাহ্যপরিস্থিতির সাথে মানবসম্পর্ককে একেবারেই আমলে আনেন না। বিপরীতে হুমায়ূন সেখানে বাহ্য পরিস্থিতিকে আমলে আনছেন, এবং খুব ভয়াবহভাবে দেখা যায় ছোটোখাটো প্রায়-গৌণ প্রভাববকের কারণেই চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। আর দ্বিতীয় যে পার্থক্যটি আজম করছেন সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের ‘মানবিকতা’ হচ্ছে ‘মহৎ’ গুণ। সেটা অন্তর্নিহিত বা অর্জিত যেকোনোভাবেই হতে পারে। অর্থাৎ সে গুণের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি/বৈপরীত্য এক বিপরীত মানুষ তৈরী করে। এ জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথের মানুষ ‘ভালো’ আর ‘খারাপে’র বাইনারিতে পড়ে যায়। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি হয় ভালো হবে, যার মধ্যে মানবিকতা থাকবে, নাহয় সে হয়ে যাবে খারাপ। হুমায়ূন এ জায়গায় এই বাইনারি ধারণা থেকে বের হয়ে আসছেন। কারণ হুমায়ূনের ‘মানবিকতা’ মানুষের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। অতএব , সকল মানুষের মধ্যেই কম-বেশি এটি থাকবে। পারিপার্শ্বিকতার কারণে এর কোনোটি লোপ পায়, কোনোটি বিকৃত হয়ে যায়। কিন্তু কখনো সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে যায় না। অর্থাৎ হুমায়ূন ‘এবসলিউট খারাপ মানুষ’ এর ধারণাটিকে নাকচ করে দিচ্ছেন এখানে।
হুমায়ূনের মানুষ সংক্রান্ত এ ভাবনাটি আমাদের খুব সুন্দরভাবে একটি দিকে পরিচালিত করবে। আমরা প্রথমদিকে হুমায়ূনের রচনার সহানুভূতি আর পক্ষপাতহীনতার যে কথা বলছিলাম , সেটাই এখানে ধরা পড়বে। রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ভালো-মন্দ জোড়ের যে বাইনারি তৈরি করছেন সে বাইনারি মূলত লেখককে চরিত্রের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে হুমায়ূন যেহেতু এই বাইনারি থেকে চরিত্রকে মুক্ত রাখছেন তাই দেখা যাচ্ছে ‘আপাত’ মন্দ বা সমাজে ‘অন্যায্য’ লোকটিও হুমায়ূনের সহানুভূতি পাচ্ছে। এ সহানুভূতির কারণ এমন নয় যে হুমায়ূন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার একটি কাউন্টার-ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। এটার কারণ অনেকটা এরকম যে মন্দের ভেতর যে ‘মানবীয় গুণাবলী’ সুপ্ত অবস্থায় আছে সেটিকে হুমায়ূন অবলোকন করছেন, প্রধান্য দিচ্ছেন। এদিক দিয়ে হুমায়ূনের মানুষ একটি আলাদা আলাপের দাবীদার অবশ্যই।
(৫)
হুমায়ূন সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় যে দ্বিধা সেটা হলো হুমায়ূন পাঠের সমস্যা। হুমায়ূন পাঠকে আজম বেশ কঠিন বলেই আখ্যায়িত করছেন। সত্যিকার অর্থেই তাই। হুমায়ূন পাঠ যে দূরহ হয়ে উঠে তার জন্য দায়ী খোদ হুমায়ূনই। হুমায়ূন আক্ষরিক অর্থেই বাজারি লেখক। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তিনি লিখছেন। এ বাজার যে শিল্প-সাহিত্যের বাজার তা নয়। বরং সেটা ছিল ক্রেতার বাজার। আর তাই হুমায়ূনের লিখায় হুমায়ূনকে আবিষ্কার করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রায়শই সিরিজ লিখেছেন। ক্রেতা-প্রকাশকের চাহিদা মাথায় রেখে। আর এসব লেখাতে আমরা লক্ষ্য করি চরিত্র ও ভাব-ভঙ্গির পুনরাবৃত্তি। অবশ্য এটা ঠিক হয়েছে কি হয় নি সে আলাপ সম্পূর্ণ গৌণ। কিন্তু লেখালেখির ক্ষেত্রে লেখা নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ যেমন একদিকে আর একদিকে পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শুধু তাই নয়। হুমায়ূন পাঠের সবচেয়ে বড় সমস্যা হুমায়ূনকে ক্যাটেগরাইজড করা যায় না। অন্যান্য লেখক যেভাবে ক্যাটেগরির মধ্যে এঁটে যান, হুমায়ূন সেভাবে আঁটেন না। বরং হুমায়ূনকে পাঠ করতে গেলে নতুন করে একটা ক্যাটেগরি তৈরি করে নিতে হয়। পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে সে কাজটা বেশ কঠিন একটা কাজই। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে যথাযথ সমালোচনা গড়ে না উঠার পেছনে একটা চলিষ্ণু সমালোচনাধারা না থাকাকে দায়ী করছেন আজম। হুমায়ূনের আরো একটি সমস্যা হলো, ‘আধুনিক’ শিল্পে যে শরীরী-প্রতিভার মহিমা আছে সেটা তাঁর মধ্যে পাওয়া যায় না। একজন শিল্পীকে প্রথমে শিল্প তৈরী করতে হয়, আর এর পরে পরিশ্রম করে সে শিল্পের চিহ্ন মুছতে হয় রচনা থেকে। এ দুটিই পরিশ্রমের কাজ। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কাজটি প্রথম ধাপেই হয়ে যায়। প্রথম ধাপেই তাঁর রচনা থেকে শিল্পের চিহ্ন মুছে যায়। তিরিশের দশকে শরীরী-প্রতিভার মহিমায় যে বাজার গড়ে উঠেছিল সে বাজারে হুমায়ূন আসলেই গৌণ ছিলেন শিল্পের এরকম ব্যবহারে।
হুমায়ূন বয়ান নিয়ে বেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তাঁর রচনায়। বিভিন্ন ধরণের প্রচলিত বয়ানভঙ্গি তিনি রচনায় ব্যবহার করেছেন। সফল হয়েছেন কি ব্যর্থ সেটা পরের বিষয়। আজমের হুমায়ূন সংক্রান্ত আলাপগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এ জায়গাতেই। হুমায়ূন আলোচনা-সমালোচনার যে ধারা আজম তৈরি করে দিচ্ছেন সে ধারার প্রধান গুরুত্বটা হলো হুমায়ূন পঠন-পদ্ধতি। হুমায়ূনকে সঠিকভাবে পাঠ করতে না পারলে হুমায়ূনের সাহিত্যের ক্যারিশমা-বুজরকি সহজে চোখে ধরা পড়বে না। হুমায়ূন হয় পূজনীয় হয়ে উঠবেন, নাহয় নিন্দনীয়। হুমায়ূনকে গ্রহন-বর্জনের প্রশ্ন তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। আজমের এ প্রয়াসটিকে তাই সাধুবাদ জানাতেই হয়। আর আজমের দেখানো পথ , চলিষ্ণু সমালোচনা ধারা তৈরির ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকাই পালন করবে।
তথ্যসূত্রঃ
১) হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে নারীমূর্তি ও সংসারচিত্র- মোহাম্মদ আজম
২) হুমায়ূন পাঠের সমস্যা- মোহাম্মদ আজম
৩) হুমায়ূন আহমেদের একটি গল্প ‘পাপ’- মোহাম্মদ আজম
৪) হুমায়ূন আহমেদের ভাষাঃ সারল্য বনাম গভীরতা-মোহাম্মদ আজম
৫) হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘এই বসন্তে’ ঃ সামষ্টিক প্রতিরোধ-প্রবণতায় ব্যক্তির সক্রিয়তা প্রসঙ্গে-মোহাম্মদ আজম।
Comments
Post a Comment