আরেক ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস আর আমাদের প্রতিরোধ

জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ আমাদেরকে বায়ান্নর পরের এক ফাল্গুনের চিত্র দেখায়। ’৫৫র ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। জহিরের এই উপন্যাসের একদম শেষ বাক্যটা খুবই আশা জাগানিয়া একটা বাক্য। “আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো”। জহিরের সেই ‘৫৫র ফাল্গুনের পরও আমরা ফাল্গুন পেয়েছি। সেই ফাল্গুনের স্মৃতিও আমাদের কাছে সুখকর না। সেই ফাল্গুনও আমাদের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শোক হিসেবেই এনেছিল। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, বাংলার বুকে প্রতিবার ফাল্গুন এনেছে শিক্ষার্থীসমাজ। ’৫২ তেও, ’৮৩ তেও। সেই ফাল্গুনের রঙ হলুদ ছিল না। ছিল কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল। দুবারই রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে রক্তে।
ছবিঃ সংগৃহীত

ইতিহাস আমাদেরকে কুখ্যাত মজিদ খান শিক্ষানীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। স্বৈরাচার এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর মজিদ খান ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে যে শিক্ষানীতির প্রস্তাবনা রাখে তার অন্যতম ভয়াবহ দিক ছিল, প্রথম শ্রেণিতে আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা, উচ্চশিক্ষায় ব্যয়ের ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বহন করা। এই দুটি বিষয় ভয়াবহভাবে আলোড়িত করেছিল শিক্ষার্থীদের। তারা প্রতিবাদ করে, বিক্ষোভ করে। অবশেষে ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের পেছনে। ঠিক যেন অবিকল বায়ান্ন। পুলিশের গুলিতে সেদিনও নিহত হয় জাফর, জয়নাল, দীপালি, কাঞ্চন। কারো কারো মতে সেদিন ৫০ জন নিহত হয়। মজিদ খান শিক্ষানীতি সেদিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন জায়গাতে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হতে পারে নি সেবার।
মজিদ খানের শিক্ষানীতি সেদিন মুখ থুবড়ে পড়লেও সেই শিক্ষানীতির আত্মাকে আমরা বারবার টেনে এনেছি। বায়ান্নকে আমরা বারবার ভুলেছি। যে বায়ান্নর দাবি ছিল , রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষাকে কি আমরা কাগজে কলমে এরপরও বাংলা করতে পেরেছি? দলিল দস্তাবেজ, উচ্চশিক্ষা আর উচ্চ আদালতের কার্যক্রম, বিভিন্ন উচ্চপদের কার্যক্রমে আমরা কি বাংলাকে পেয়েছি? বায়ান্নর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আন্দোলনে কৃষকের স্টেইক ছিল রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলে কাগজে কলমে উর্দু লিখা হবে, সে প্রতারিত হবে। শিক্ষার্থীদের স্টেইক ছিল, যদি রাষ্ট্রভাষা উর্দু হয়, কেতাবের ভাষা উর্দু হয় সে চাকরি পাবে না। তাই সকলেই ভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে পেরেছিল।
’৮৩ তেও তাই। প্রথম/দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে একটি শিশুকে বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজি আর আরবি শেখানোর যে চেষ্টা করা হয় সেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক আর বৈষম্যমূলক। ঠিক যে কারণে/যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল একইভাবেই ইংরেজি আর আরবীকে চাপানোর চেষ্টা হয়েছে। আর উচ্চশিক্ষায় ৫০ শতাংশ ব্যয় নিজেকে বহন করার অর্থ হলো , শিক্ষা হয়ে গেল মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জন্য। গরীবের স্থান আর সেখানে থাকল না। মুক্তিযুদ্ধের মতো গণযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশ স্বাধীনতা নিয়ে এসেছে সেখানে শিক্ষায় এরূপ নীতি কোনোভাবেই কার্যকর হতে পারে না। অথচ অবাক করার বিষয় হলো, তিরাশির ভূত বারবার আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে। আমরা এখনো ‘মুষ্টিমেয়র জন্য শিক্ষা’ নীতিতেই উচ্চশিক্ষা নীতি বানাই। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা নাকি ইতিহাস থেকে মানুষ কোনো শিক্ষাই নেয় না। তাই ’৫২ এর পরও আমরা ’৮৩ দেখেছি, আজ দেখছি।
বাঙালি ঐতিহাসিকভাবেই নির্যাতিত এক জাতি। এই জাতির ইতিহাস হলো সংগ্রামের ইতিহাস। এই হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাসে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ইলিমেন্ট খুঁজে পাই। আর সেটা হলো, রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা। যতবারই এই জাতির দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে, প্রত্যেকবার তারা প্রতিরোধ করেছে। আর অদ্ভুতভাবে প্রতিরোধ করে বেশিরভাগই সফল হয়েছে। জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন এইখানেই গুরুত্ব পায়। কবি রসুল যখন বলে “জেলখানা আরো বাড়ান সাহেব,এত ছোট জেলখানায় হবে না” তখন সেটা তাই এক ধরনের মাহাত্ম্য বহন করে। আমাদেরকে প্রতিনিয়ত খাঁচার মধ্যে বন্দি করার যে পায়তারা, সেই খাঁচাটাকে আমরা হয়তো এখনই ভাঙতে পারব না। কিন্তু আমাদের ইতিহাস , আমাদের রক্ত আমাদের সেই খাঁচা প্রসারণের দিকে নিয়ে যাবে। রসুলের সেই জেলখানা তাই প্রসারিত হবেই , হতে বাধ্য। কারণ , প্রতিটা ফাল্গুনেই আমরা দ্বিগুণ হচ্ছি। প্রতিটা ফাল্গুনেই আমাদের সামষ্টিক প্রতিরোধের মাত্রা বাড়তে থাকবে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের মহিমায় আজকের ভালোবাসা দিবস। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নিয়ে যেসকল গল্প চালু আছে তাঁর প্রত্যেকটাই বীরত্বসূচক। ক্যাথলিক চার্চ অন্তত তিনজন ভ্যালেন্টাইনের কথা উল্লেখ করে এবং ভিন্ন কাহিনী বলে। কিন্তু প্রত্যেকটি গল্পেই ভ্যালেন্টাইনের অন্তিম পরিণতি ছিল মৃত্যু। ভ্যালেন্টাইন বিদ্রোহ করেছিল। সে বিদ্রোহ ধর্মের জন্যও হতে পারে, ভালোবাসার জন্যও হতে পারে। বাংলার পঞ্জিকায় তাকালে সে বিদ্রোহও একটা ফাল্গুনেই হয়তো পড়বে। ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসার জন্য মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিল। আমাদের লড়াইটাও এক দিক থেকে ভালোবাসার জন্য। আমাদের লড়াইটা মানবিক এক রাষ্ট্রের জন্য। অনাগত যে শিশু তার জন্য একটা সুন্দর পৃথিবীর জন্য। ইতিহাস তাই আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় স্বৈরশাসকের পতনেই স্বৈরতন্ত্রের পতন হয় না।
ভালোবাসা আর স্বৈরাচার একসাথে যায় না। ভালোবাসতে মুক্ত বাতাস দরকার,ভালোবাসতে অবাধ স্বাধীনতা দরকার। কাঞ্চন,দীপালি ,জয়নালও ভালোবাসতেই চেয়েছিল। মুক্ত বাতাসে ভালোবাসার ঘ্রাণ নিতে চেয়েছিল, ছুটে বেড়াতে চেয়েছিল ভালোবাসার মানুষটার সাথে! রাষ্ট্র দেয় নি! রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক যন্ত্রে পরিণত হয়, রাষ্ট্র যখন স্বৈরাচারি হয় তখন রাষ্ট্র শুধু রক্ত খোঁজে। জয়নাল,দীপালি,কাঞ্চনদের রক্তও রাষ্ট্র শুষে খেয়েছে। কিন্তু জোঁকের রক্তক্ষুধা কি কখনো থামে? দ্বি-জাতি তত্ত্বের আমরা প্রথমে ব্রিটিশ-ভারতীয় সমাজ থেকে হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি হয়ে ভাগ হলাম! সেই হিন্দু-মুসলিম দুইজাতিও থাকে নি, বাঙালি-পাকিস্তানি প্রশ্ন আসলো, আমরা বাঙালি পরিচয় নিলাম! এরপরও কি লড়াই থেমেছে? থামে নি! রাষ্ট্রও তার রক্ত শোষণ বন্ধ করে নি তাই। রক্তের নেশা আফিমের নেশার চেয়েও বড় নেশা। আমাদের মুক্তি হয় নাই। বায়ান্নর আন্দোলন ছাড়া কোনো আন্দোলনের ফসল বোধ হয় আন্দোলনকারীর ঘরে যায় নি। স্বৈরশাসকের পতনের ফলে স্বৈরশাসনের পতন হয় নি,হয় না! স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ফসল ও তাই কতটুকু সত্যিকার আন্দোলনকারীদের ঘরে উঠেছিল জানি না! রাষ্ট্র স্বৈরাচারী হলে প্রেমিক-প্রেমিকাও স্বৈরাচারী হবে! এই ভালোবাসাহীন সমাজে প্রেমিক-প্রেমিকার প্রকাশ্য আলিঙ্গন স্বৈরাচারের মুখে চপেটাঘাত! আসুন ভালোবাসি,তবে ইতিহাসকে ভুলে গিয়ে নয়,সাথে নিয়ে!

Comments