আত্মহত্যাঃ কর্তাসত্তার খুন আর রাষ্ট্রের দায়
আত্মহত্যা কি কর্তাসত্তার খুন?
(১)
মাত্র কিছুদিন আগেই বড় হেডিং এর একটা নিউজ দেখলাম। 'শাবিপ্রবিতে গত এক দশকে দশ আত্মহত্যা'। এর সর্বশেষ আত্মহত্যাটি হয়েছে ১৪-১৫ দিন আগে। বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর। এরপর গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমামের আত্মহত্যা। আজকেও আরেকজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার সংবাদ। আত্মহত্যা জিনিসটা মেন্টাল হেলথের প্রশ্নটাকে যেমন সামনে টেনে আনছে তেমনি টেনে আনছে কর্তাসত্তার প্রশ্নকে। টেনে আনছে ব্যক্তির উপর সমাজ, রাষ্ট্রের দায়কে। সমাজ-রাষ্ট্রের দায় ব্যতীত আত্মহত্যার পোস্টমর্টেম করা সম্ভব না।
আত্মহত্যা মানে কি? আত্মহত্যা মানে হলো নিজের সত্তাকে নিজে মেরে ফেলা। কিন্তু আদতে কোনো আত্মহত্যাতে কি কেউ স্বেচ্ছায় নিজের সত্তাকে মেরে ফেলে বা খুন করে? সেলিম রেজা নিউটন তাঁর একটা লিখায় বলেছিলেন, প্রত্যেকটা অপরাধই একেকটা রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় অপরাধ। আত্মহত্যার ক্ষেত্রেও একই। কেন আত্মহত্যা রাষ্ট্রীয় খুন, সেখানে সমাজের দায় কি ছিল সেটা নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। এই যে আমরা individual বা ব্যক্তি বলি এটা নিজেই আলাদা একটা বাস্তবতা। এমা গোল্ডম্যান বলছেন, ব্যক্তির এই স্বকীয়তা বজায় রাখতে আসলে রাষ্ট্র, সমাজ, জাতি এসব বিমূর্ত ধারণার দরকার পড়ে না। বরং ব্যক্তিসমষ্টি মিলে ব্যক্তির স্বকীয়তাবিরোধী 'সমাজ' 'রাষ্ট্র' র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে। এই ব্যক্তিসত্তাটা রাষ্ট্র কতটুকু বাঁচিয়ে রাখতে দিচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আত্মহত্যার ডায়নামিক্সে যে আলাপটা একদমই করা হয় না। এই আলাপ না করার কারণ হচ্ছে খুন/হত্যা/মৃত্যু এসকল ধারণা মূলত দৈহিকতার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। দেহ সংক্রান্ত জন্ম-মৃত্যু ভাবনা সত্তাকে(স্পিরিচুয়ালিটি না) খারিজ করে দেয়। দেহসর্বস্ব হয়ে ওঠার কারণে মানুষের দৈহিক মৃত্যুর রেজিস্টার হয়, সত্তার মৃত্যুর কোনো রেজিস্টার হয় না।
(২)
এই যে কর্তাসত্তার কথা বলছি বা ব্যক্তিকতার কথা বলছি এই জিনিসগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ? ব্যক্তিকতা হচ্ছে ব্যক্তির চৈতন্য। আর কর্তাসত্তা হচ্ছে মানুষের ব্যাসিক হিউম্যান এজেন্সী বা তার মোরাল এজেন্সী। এই বিষয়গুলোর কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু হয় না, এগুলোর হয় খুন। রাষ্ট্র যখন সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে তখন আপনাকে ভেড়ার পালের একটা ভেড়ার মতো ট্রীট করে। আপনার ব্যক্তিকতা বা কর্তাসত্তা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না তখন তার কাছে। সে প্রতিনিয়ত খুন করে চলে এসব ব্যক্তিকতা আর কর্তাসত্তার। আত্মহত্যা জিনিসটা নামের মতোন ব্যক্তিগত কোনো বিষয় না তাই।
কারো কাছে মনে হতেই পারে রেজাল্ট খারাপ হওয়ায়, প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায়, ব্যক্তিগত জীবনের ঝামেলায় মানুষ আত্মহত্যা করে, এগুলো ব্যক্তিগত না হয়ে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বিষয় কিভাবে হয়? এখানে চিন্তা করতে হবে জীবন যাপনের উপর সমাজ, রাষ্ট্রের প্রভাবটা কিভাবে কাজ করছে সেটা দিয়ে। লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, রাষ্ট্র ব্যক্তির ব্যক্তিকতা আর কর্তাসত্তার উপর আঘাত হানে আপনাকে অধিকারহীন জীবন দেয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ আপনাকে কেবল দেহসর্বস্ব করে তোলার যে প্রকল্প সেটা রাষ্ট্রীয়ই। কোনোরকমে বেঁচে থেকে আপনি যে 'bare life' বা উন্মুক্ত জীবন যাপন করছেন সে জীবনে কোনো অধিকার থাকে না। আপনার অস্তিত্ব কেবল আপনার দেহের মধ্যে। আপনার কর্তাসত্তা আর আপনার অস্তিত্বের পরিচায়ক হতে পারে না। এভাবে বারবার প্রথমে ব্যক্তিকতা আর কর্তাসত্তা খুন হয়। এরপর সবশেষে দৈহিক মৃত্যুটা ঘটে। এই দৈহিক মৃত্যু কারো স্বাভাবিক হয়, কারো দুর্ঘটনায় হয়, আর যারা অতি সংবেদনশীল, যারা এসব অনাচার, ব্যক্তিসত্তার মৃত্যুকে মানতে পারে না তারা আত্মহনন করে। এই যে বিশাল প্রক্রিয়ায় সবাই কেবল শেষ অংশটুকু দেখে। দৈহিক মৃত্যুটাকে। কেউ আগের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলে না। তার কারণ আমি আগেই বলে রেখেছি৷ আমাদের দেহসর্বস্ব বাস্তবতা।
(৩)
আগের দুটি পয়েন্টে আমি আত্মহত্যা কিভাবে কর্তাসত্তা খুন হওয়ার মাধ্যমে হয় সেটা বলার চেষ্টা করেছি। এবারে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কাউন্সেলিং এর প্রশ্ন। আত্মহত্যা রোধের জন্য এই যে কাউন্সেলিং এর ধারণা, সেটা বেশ জনপ্রিয় একটা ধারণা। এখানে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কাউন্সেলিংটা করবে কার? ব্যক্তির? না সমাজ-রাষ্ট্রের?
প্রচলিত ধারায় কাউন্সেলিং হয় ব্যক্তির। এই কাউন্সেলিং কি ব্যক্তির ব্যক্তিকতা কিংবা কর্তাসত্তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে? নাকি এখানে ব্যক্তিকে ভিক্টিমের বদলে অপ্রেসর হিসেবে নিয়ে কাউন্সেল করে? এখানে বুঝতে হবে যে আত্মহত্যায় উদ্ধুদ্ধ হওয়া ব্যক্তিরা ভিক্টিম। তাদেরকে এই টেন্ডেন্সি থেকে ফেরানোর পথ একটাই। কর্তাসত্তা বা মানবীয়তা ফেরত দেয়া। ব্যক্তি যখন নিজস্ব ব্যক্তিকতায় নিজেকে মাতিয়ে রাখবে তখন আর তার আত্মিক মৃত্যু ঘটবে না প্রতিপদে। আত্মিক মৃত্যু না ঘটলে কেউ সুখে আত্মহনন করতে যাবে বলে আমার মনে হয় না। তাই এখন কাউন্সেলিং দরকার, সমাজকাঠামোর, কাউন্সেলিং দরকার রাষ্ট্রকাঠামোর। প্রতিপদে, নানাভাবে উন্মুক্ত অধিকারহীন জীবন যাপনের বদলে দরকার মানবিক জীবন যেখানে কর্তাসত্তার বিকাশ হবে, যেখানে বিকশিত হবে ভালোবাসা, দয়া, মানবিকতা!
Comments
Post a Comment