কুর্মিটোলা রেইপ ভিক্টিমের ভাষ্য এবং আমাদের চিন্তার জগতে আঘাত

 
বাংলাভাষায় খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্মস্পর্শী একটা লেখার সন্ধান পেলাম আজ। লেখাটা এ বছরের শুরুরদিকে কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর। এই লেখার প্রধান গুরুত্বের কারণ হচ্ছে বাংলা ভাষায় যুদ্ধ ব্যতীত অন্যান্য কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার কোনো নারীর সরাসরি বয়ান এভাবে পাওয়া যায় নি। এ বাদেও এই লিখা যেসব জায়গায় আঘাত করেছে তা সমাজের এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রচলিত কন্সট্রাকশনকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ নিয়ে সমাজে বা সমাজকাঠামোতে যেসব প্রচলিত ধারণা আছে সবকিছুকে একরকম দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার মতো এই লেখা।
ভিক্টিমের কথা ধরে ধরেই কিছু কথা বলা যায়। তিনি শুরু করছেন এভাবে, “আমি কখনো মনে করি নাই বাংলাদেশের রাস্তাঘাট আমার জন্য নিরাপদ, কিন্তু সবসময় বিশ্বাস করেছি গায়ের জোরে মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কারণ যারা হয়, তারা আমার জীবনের গতি নির্ধারণ করে দেবে না, আমি দিতে দেবো না।
সেইজন্যই বোধহয় অনেক জঘন্য সহিংসতার শিকার হওয়ার পরও আমি নিজের জীবন নিয়ে মোটেই শঙ্কিত হয়ে যাই নাই। আমি আমার জীবনাচরণ একটুও বদলাই নাই। আমি ভয় পেয়ে থেমে যাই নাই।”
খুব সম্ভবত নিকট ইতিহাসে এরকম রেজিস্ট্যান্সের গল্প আমরা খুব একটা বেশি দেখি নাই। এই যে ভিক্টিম ধর্ষণের শিকার হয়েও ধর্ষণের বিরুদ্ধে ভোকাল হচ্ছেন এই জিনিসটা আমাদের জন্য খুব পজিটিভ দিক। পাশপাশি ভিক্টিমের বয়ানে আমরা রেইপ কেইসের যে এনালাইসিস পাচ্ছি সেটা খুবই সিগনিফিক্যান্ট। ভিক্টিমের ভাবনাগুলো যেকোনো সাধারণ ,চিন্তাশীল মানুষেরই ভাবনা। এই ভিক্টিম কিন্তু নিজের ঘটনাটাকে আলাদা করে ফেলেন নাই অন্য ঘটনাগুলো থেকে। যার কারণে এটার গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে। তিনি যখন বলছেন “আমার একটা নাম আছে। কিন্তু সেটার দরকার নাই। আমার মতো অনেক মেয়ে প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হয়। ” তখন আসলে তিনি মিলেমিশে একাত্ম হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া রেইপ ভিক্টিমদের সাথে। তিনি তখন আর কোনো আলাদা সত্তা না প্রতিবাদের ক্ষেত্রে,তিনি একটা সামষ্টিক সত্তা। তিনি সকল রেইপ ভিক্টিমের সম্মিলিত কন্ঠস্বর।
এই ভিক্টিম খুব আফসোস নিয়েই সম্ভবত লিখছেন , “ যারা এই লেখা পড়ছেন, তাদের মাঝে অনেক মানুষই বিশ্বাস করেন অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত মজনু আসলে আমাকে ধর্ষণই করেনি, কারণ সে 'ধর্ষণ করতে পারে না।' ” এই জিনিসটা আমাদের সোশাল কন্সট্রাকশনের অনেক বড় একটা গলদ যে আমরা কোনো ঘটনার সামষ্টিক প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হই। আমরা ভিক্টিম ব্লেইমিং করি, আমরা একিউজডকে রক্ষা করার চেষ্টা করি। ভিক্টিমের পরের স্টেইটমেন্টটা আরো জোরালো।
“কিন্তু এটাও ভাবি যে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী মারাত্মক করুণ অবস্থা যে ভিকটিমের ব্যাপারে কোনো ধারণা ছাড়াই মানুষ মন্তব্য করে ফেলতে পারে 'বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী'কে 'মজনুর মতো' মানুষ ধর্ষণ করতে পারে না, কিন্তু তাকে দিয়ে যে কেউ যা খুশি তাই বলিয়ে নিতে পারে - সেখানে যদি একজন মানুষের জীবনের প্রশ্ন যুক্ত থাকে তাও।”
আমাদের তথাকথিত শিক্ষায় ধাক্কা দেয়ার মতো কিছু কথা। আমাদের চিন্তাচেতনার দৈন্যকে খুব রাইটলি ট্রেস করেছেন ভিক্টিম। তিনি কিভাবে সামষ্টিক কণ্ঠস্বর হচ্ছেন রেইপ ভিক্টিমদের তার আরো একটা উদাহরণ তার বক্তব্যেই আছে।
“শনাক্ত করার পর ফোনে র‍্যাবের পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয় তারা খুবই 'সরি' যে আমাকে রক্ষা করতে পারে নাই। আমি তাদের বলেছিলাম আমাকে সরি বলতে হবে না - তারা যেন দেখে আর কারো সাথে যেন এমন না হয়। তারা জানিয়েছিলেন অবশ্যই দেখবেন। কিন্তু তার পরের দশ দিনেই বহু রেপ কেস রিপোর্টেড হয়েছে।”
আমি এই ভিক্টিমের মানসিক শক্তির প্রশংসা না করে পারি না। তিনি নিজে মানসিক একটা ট্রমার মধ্যে থাকার পরেও অন্য ভিক্টিমদের কথা ভাবছেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জোর দাবি জানাচ্ছেন এরকম ঘটনা বন্ধ করার ক্ষেত্রে তৎপরতা গ্রহণ করার জন্য কিংবা তাদের ব্যর্থতা ট্রেস করতে।
আরো ইন্টারেস্টিং একটা পয়েন্ট এই লিখার, ভিক্টিম আমাদের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারাকে ক্রিটিক করছেন এভাবে “আমি অনেক 'সৌভাগ্যবান' যে আদালতে আমার নিজেকে 'সচ্চরিত্র' প্রমাণ করার যুদ্ধটা করতে হয় নাই। ” সাক্ষ্য আইনের এই ধারায় অভিযোগকারীকে বিরোধী পক্ষের আইনজীবী ‘দুশ্চরিত্র’ প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এই জিনিসটার প্রতিবাদ রেইপ ভিক্টিমের পক্ষ থেকে আসাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবং এই ভিক্টিম এই প্রতিবাদটা খুব রাইটলি করেছেন। এই ভিক্টিম বলছেন পুলিশ চাইলেই সব পারে। আসলেই তাই। মামলাগ্রহণ থেকে শুরু করে, তদন্ত প্রক্রিয়ার দ্রুততা,এমনকি সঠিক বিচার চাওয়ার পথের রাস্তাটা সহজ করে দেওয়া,সবই তাঁরা পারেন। ভিক্টিম নিজের ঘটনাটার উদাহরণই টানছেন এক্ষেত্রে।
আমি খুব অবাক হয়ে ভিক্টিমের লেখার শেষ দুটো প্যারা পড়ি। যে কথাগুলো আমাদের শিক্ষিত চিন্তাশীল সমাজ খুব ঠান্ডা মাথায়ও ধরতে পারেন না এমন কথাগুলো শারীরিক,মানসিক ট্রমার শিকার একজন ভিক্টিম জোর গলায় আমাদের বলছেন।প্রথম কথাটা হচ্ছে,
“পৃথিবীতে যদি কোনো মানুষের অন্য একজনকে আঘাত করার প্রয়োজন না পড়তো - তাহলে নিশ্চয়ই বেঁচে থাকা অনেক সুন্দর হতো! ”
কি অদ্ভুতভাবে নির্মমতার শিকার একজন মানুষ ভায়োলেন্সের বিপক্ষে কথা বলছেন একবার ভাবুন। আমাদের এখানে যখন মধ্যযুগীয় বর্ববরভাবে মানুষকে নির্যাতন করা নরমালাইজ হয়ে যাচ্ছে সে সময়ে দাঁড়িয়ে ভায়োলেন্সের শিকার একজন মানুষ ভায়োলেন্সের এগেইন্সটে কথা বলছেন। আরো অবাক হই যখন একজন রেইপ ভিক্টিম খুব ঠান্ডা মাথায় ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুন্দন্ড করলে যে এ অপরাধ কমবে না সেটা বলছেন।
“শুধু দুই একটা আলোচিত ঘটনার বিচার করে যেমন ধর্ষণ বন্ধ হবে না, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করেও ধর্ষণ বন্ধ হবে না। সমস্যাটা গোড়া থেকে ঠিক করতে হবে, ধর্ষক উৎপাদন হওয়াই বন্ধ করতে হবে। ”
এই ভিক্টিমের এই বক্তব্যের মতো শক্তিশালী কোনো বক্তব্য আমি কখনো শুনি নি। তিনি যে মানবিক রাষ্ট্র গড়ার আহবান আমাদের জানাচ্ছেন সেটা স্পষ্ট প্রমাণ করে তিনি কতটা মানবিক আর কতটা এই ধর্ষণ, বা উৎপত্তি বা এটা বন্ধ করার রাস্তা সম্পর্কে জানেন। এই ভিক্টিমের সামনের জীবনের জন্য শুভকামনা জানাতে পারাটা আমাদের জন্যই বিরাট পাওয়া। তার কথা দিয়েই শেষ করা যায়,
“ধর্ষণের শিকার না হওয়াই আমাদের অধিকার ছিল।”
এই অধিকারের জন্যই নাহয় সবাই লড়ি আমরা!

ভিক্টিমের লেখার লিংকঃ https://tinyurl.com/yyx9qsk4


Comments