সাংগঠনিক গণতন্ত্র ও ক্যাম্পাস সংস্কৃতি

সংগঠন মূলত মানুষের সংঘবদ্ধ একটা প্রচেষ্টার জায়গা। কমিউনিটি বা সম্প্রদায় বা দল থেকে সংগঠনের পার্থক্যের জায়গা কাজকর্ম সংগঠিত হওয়ার দিক থেকে। আর প্রতিষ্ঠান থেকে পার্থক্য হওয়া উচিত কাঠামোগত ছাঁচ থেকে কিছুটা বেরিয়ে উদারভাবে কার্যসিদ্ধির দিক থেকে। অতএব একদিক থেকে দেখতে সংগঠন হলো দল আর প্রতিষ্ঠান- এ দুইয়ের মধ্যবর্তী কিছু। তাই সংগঠন এ দুইয়ের মধ্যে যেদিকে বেশি ঝুঁকবে সেদিকটাই সংগঠনের চরিত্রও তেমনটাই হয়ে উঠবে। সামষ্টিকতা বা সমগ্রতা বিবেচনায় গোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আর গোষ্ঠীর সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালায় দরকার সংগঠন৷    অতএব সামষ্টিকতা বা সামষ্টিক চিন্তার ভিত্তিতে সংগঠনের গুরুত্ব অবশ্যই অপরিসীম। তবে সংগঠনের মানবিকতা, কার্যসিদ্ধি নির্ভর করে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ এবং সাংগঠনিক গণতন্ত্রের বিদ্যমানতার উপর। আমরা সুবিধার স্বার্থে আলাপটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করব এবং পরবর্তীতে সে আলাপ থেকে আমরা একটি মন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করব।




সংগঠনের আদল

সংগঠন আর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে পার্থক্যটুকু বিদ্যমান সে পার্থক্যটুকু অনেকটা এরকম যে,  প্রতিষ্ঠান অনেকটা দৃঢ়, সেক্ষেত্রে সংগঠন অনেকটা নমনীয় চরিত্র ধারণ করে।  অথচ সংগঠনে আমরা যে আদল লক্ষ্য করি সেটা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক ছাঁচেই। সভাপতি-সম্পাদককে মুড়ো বানিয়ে আস্ত কমিটি করা হয়। যেখানে একটা ক্ষমতাপ্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়ে যায়। সে ক্ষমতাপ্রশ্ন সংগঠনের ভেতরেই শ্রেণিবিভেদ তৈরি করে যেমন একদিকে,অন্যদিকে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের রূপ ধারণ করে। তাই সংগঠনের আদল শ্রমবিভাগের ভিত্তিতে হওয়ার পরিবর্তে হয়ে উঠে শ্রেণি/ক্ষমতা ভিত্তিতে। এবং এ ক্ষমতার স্বরূপটা ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারের রূপ ধারণ করে। 

গণতন্ত্র ও অধিকার

গণতন্ত্র শব্দটার ব্যবচ্ছেদ করলে গণ এবং তন্ত্র এ  দুইয়ের সম্মিলন দেখা যায়। অর্থাৎ গণের জন্য যে তন্ত্র সেটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র আর অধিকারের মধ্যে দ্বিমুখী সম্পর্কটি অনেকটা এরকম পাওয়া যায় যে গণতন্ত্র মাত্রই গণের অধিকারের কথা বলবে, অধিকার নিশ্চিত করবে, আর উল্টোটাও সমভাবে সত্য, গণের অধিকার আদায়ের জন্য গণেরই তন্ত্র প্রয়োজন। গণতন্ত্র স্বেচ্ছাচারকে নাকচ করে, গণতন্ত্র সম্মিলিত সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেয়। আর এই গণতন্ত্রই হয়ে উঠে মানবমুক্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ।  সংগঠনের ক্ষেত্রে অধিকার আর গণতন্ত্রের এই দ্বিমুখী সম্পর্কের চর্চার জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সংগঠন গণমুখী হওয়ার সর্বপ্রথম শর্ত হলো, সে সংগঠনকে অভ্যন্তরীণভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত হলেই সংগঠনকর্মীরা তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারবে, আবার অধিকার নিয়ে কথা শুরু হলে সেটা গণতন্ত্রের দিকেই সংগঠনকে নিয়ে যাবে। 

একব্যক্তিক কাঠামো

সার্বজনীনভাবে দেখতে গেলে সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্র আর সবচেয়ে ছোটো ইউনিটটি হলো পরিবার। এই দুইয়ের কাঠামোর উপর গোষ্ঠীগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের কাঠামো নির্ভর করে। বাংলাদেশে আমরা যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর চর্চা করি সেটা সম্পূর্ণ একব্যক্তিক কাঠামো। সেটা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সকল জায়গাতেই। আর সেটার প্রভাব বিদ্যমান থাকে সংগঠনগুলোতেও। সংগঠনের সভাপতি/সম্পাদক ঘরানার কাঠামো সংগঠনকে একব্যক্তিক কাঠামোতেই পরিণত করে যেখানে সংগঠনের মাথা থাকে উল্লেখিত পদটি। আর সেই পদের হাতে থাকে সকল ক্ষমতা। সেই পদ চাইলে কর্মী ছাঁটাই করতে পারে, চাইলে কর্মীর কাজের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে।  এই স্বাধীনতাবিহীন-অগণতান্ত্রিক এক ব্যক্তিক কাঠামোই হয়ে ওঠে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচারের অঘোষিত আইন৷ আর এই একব্যক্তিক মডেল জন্ম দেয় সাংগঠনিক আমলাতন্ত্রের। সেই আমলাতন্ত্রে নেতা থাকে, পাতিনেতা থাকে আর থাকে কর্মী। এই ক্ষমতাতান্ত্রিক যে বিন্যাস সে বিন্যাস হয়ে যায় সাংগঠনিক গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকির স্বরূপ।

সংগঠন ও সম্পর্ক

সংগঠন মানেই মানুষ। মানুষ ছাড়া সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই সংগঠনে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক কেমন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্ক আর ক্ষমতাসম্পর্ক দুটি আলাদা বিষয়। দুজন ব্যক্তির মধ্যে ক্ষমতাসম্পর্কে যদি স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া হয় তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন জাগে সেই ক্ষমতাসম্পর্কের বন্টন কেমন হবে। সংগঠনের দুইজন ব্যক্তির মধ্যকার ক্ষমতাসম্পর্ক যদি সমান বা ইকুয়াল হয় তখন আমলাতন্ত্র সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু সেই ক্ষমতাসম্পর্ক যদি হয় অসম , তবে সেখানে একটি অঘোষিত আমলাতন্ত্র সৃষ্টি হবেই। আর আমরা ইন্টিমেসি বা সম্পর্কের স্বাভাবিকতা যেটাকে বলি সেটাতে একটি ছেদ সৃষ্টি হবে। অতএব সংগঠনের কর্মীদের ভেতরকার ক্ষমতাসম্পর্কের ধরন যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠনের সবচেয়ে শিথিল রূপ তাই ক্ষমতার সম-বন্টনের মাধ্যমেই তৈরি হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি

সংস্কৃতি বলতে খুব সহজভাবেই যদি চলন-বলন-আচরণের ধরন ধরে নিই, তবে আমরা দেখতে পারি যে সংস্কৃতি শুধু দেশ-সমাজের হয় তা না,বরং অন্যান্য ফাংশনাল বডি যেমন , প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিরও হতে পারে। প্রতিষ্ঠান যেহেতু একটা ফুলস্টপ, তার আগে পরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই অতএব , প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিও অনেকটা রিজিড বা শক্ত ধরনের। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু প্রতিষ্ঠান তাই তার মধ্যকার সেই রিজিডিটি আমরা দেখতে পাই তার চর্চিত সংস্কৃতির মধ্যেই। বিশ্ববিদ্যালয় যে সংবিধান দিয়ে চলে সেই সংবিধানই তার পবিত্র গ্রন্থ এবং সেই সংবিধানই এই বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি কেমন হবে সেটা নির্ধারণ করে দেয়।

ক্যাম্পাস সংস্কৃতি

বিশ্ববিদ্যালয় আর ক্যাম্পাস এই দুটিকে সজ্ঞানেই আলাদা করে ক্যাম্পাসকে প্রতিষ্ঠানমুক্তির একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্যাম্পাস কেবল জড় ইট-পাথর আর স্থাপনা না, ক্যাম্পাসের সাথে জনসম্পৃক্ততার একটা ব্যাপার আছে। এই জনসম্পৃক্ততার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি থেকে ক্যাম্পাস সংস্কৃতি আলাদা হতে পারে। এতটুকু স্বাতন্ত্র্য তার আছে। অতএব সাংগঠনিক সংস্কৃতির পরিবর্তনে সর্বপ্রথম বিনির্মাণ করতে হবে ক্যাম্পাস সংস্কৃতি। ক্যাম্পাস সংস্কৃতি যদি সামন্ততান্ত্রিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তবে সেই সংস্কৃতি হয়ে ওঠবে সর্বগৃহীত। সকল প্রকার স্বৈরতন্ত্রকে, অনিষ্টকে সে মোকাবেলা করার চেষ্টা করবে। তাই একটি ক্যাম্পাসের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংগঠন দাবি করার পূর্বশর্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস দাবি করা।

সংগঠন ও শিল্প-স্বাধীনতা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংগঠনচর্চা বিশেষ করে সাংস্কৃতিক সংগঠনের চর্চার প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিল্পচর্চা। শিল্পের জন্য শিল্প( আর্ট ফর আর্ট সেইক) এর বদলে যদি জীবনের জন্য শিল্প(আর্ট ফর লাইফ সেইক) হয় তবে শিল্প গণমুখী হয়ে ওঠে। সংগঠনের শিল্পচর্চাও তাই যদি প্রাণে প্রাণ মেলানোর শিল্পচর্চা হয় তবে নিঃসন্দেহে সেটি গণমুখী হয়ে ওঠবে। তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এখানে শিল্প-স্বাধীনতা। সংগঠনের শিল্প-স্বাধীনতা সম্পূর্ণ জড়িয়ে আছে সংগঠনের বিদ্যমান গণতন্ত্র কেমন তার ওপর। সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভেতরে যদি অবাধ শিল্পচর্চার সুযোগ না থাকে তবে চর্চা হয়ে ওঠবে একমুখী। তাই সাংগঠনিক গণতন্ত্র এরূপ হতে হবে যাতে তা কোনোভাবেই ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তায় বাধা না দেয় এবং শিল্পচর্চায় বাধা না দেয়।

গণতান্ত্রিক সংগঠনের রূপরেখা

গণতন্ত্র মানে গণ-ক্ষমতা-তন্ত্র। অর্থাৎ এখানে ক্ষমতার বিন্যাস হবে সমান। গণতান্ত্রিক সংগঠনের রূপরেখা ঠিক করতে গেলে তাই গণক্ষমতাতন্ত্রই হতে হবে। সংগঠনের সকল সদস্যদের স্টেইক সমান হতে হবে। কোনোরূপ আমলাতান্ত্রিক কাঠামো সেখানে বিদ্যমান থাকতে পারবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হতে হবে গণতান্ত্রিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কাজের বন্টন। গণতান্ত্রিক সংগঠনের কাজের বন্টন হতে হবে সংগঠনের সদস্যদের ইচ্ছা, আগ্রহ অনুযায়ী গণতান্ত্রিক উপায়ে। সংগঠনের সংবিধান হলো তার গঠনতন্ত্র। এই গঠনতন্ত্র সংশোধন বা বিনির্মাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংগঠনের গঠনতন্ত্রে সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রূপ তৈরি করতে হবে। তবে সতর্কতার বিষয় হবে, সে রূপ কোনোভাবেই যাতে ব্যক্তিতান্ত্রিক বা পদতান্ত্রিক হয়ে ওঠতে না পারে।

সংগঠনের গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠাটা সাংগঠনিক মানবিকতার গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা যেভাবে স্বদেশ বিনির্মাণের কথা বলি তেমনিভাবেই আমাদের চারপাশটারও সংস্কার, বিনির্মাণ করতে হবে। গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় চাইতে গেলে ক্যাম্পাস সংস্কৃতি আর সাংগঠনিক সংস্কৃতির বিনির্মাণ ছাড়া উপায় নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে মানবিক প্রতিষ্ঠান করে তুলতে চাইলে অবশ্যই ক্যাম্পাস সংস্কৃতি আর সাংগঠনিক সংস্কৃতির গণতান্ত্রিকতা নিশ্চিত করতে হবে।




Comments