পদার্থবিজ্ঞান,দর্শন এবং পদার্থবিজ্ঞানের দর্শন
দর্শন বিষয়টি মূলত প্রকৃতির মৌলিক যে প্রশ্নগুলো সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে।অস্তিত্ব,জ্ঞান কিম্বা ভাষা এসব বিষয়ে দর্শন প্রশ্ন করে এবং সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।অপরদিকে পদার্থবিজ্ঞান মূলত প্রকৃতির মৌলিক কণা ,কিম্বা মৌলিক যে ফেনোমেনা বা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। অতএব এ দুয়ের মধ্যে একটা সম্পর্কের জায়গা যে আছে সেটা নিশ্চিত। ‘ফিলসফি’ টার্মটির প্রবক্তা হিসেবে পীথাগোরাসের নাম উঠে আসে।এই ফিলসফির যে মেথড অর্থাৎ প্রক্রিয়া তার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বৈশিষ্ট্য হলো প্রশ্ন করা, সমালোচনা বা আলোচনা করা, র্যাশনাল আর্গুমেন্ট দাঁড় করানো প্রভৃতি। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে আরেকবার চোখ বুলালে দেখা যাবে যে এই সকল বৈশিষ্ট্য আবার পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যেও খুব করে বিদ্যমান।আর্গুমেন্ট মূলত
অনেকগুলা স্টেইটমেন্টের একটা সিরিজ। একটা বাক্য বা স্টেইটমেন্টের সত্যের মাত্রা
খুঁজে বের করার জন্য মূলত লজিক দরকার।লজিক হলো মূলত যুক্তি বা রিজনিং সংক্রান্ত
বিদ্যা।লজিক সংক্রান্ত আলাপ আমরা পরে করব। পদার্থবিজ্ঞান শিখার শুরুতেই আমরা প্রশ্ন করা শিখি, একটা প্রসেস বা মেথডের সমালোচনা করতে শিখি,একটা র্যাশনাল আর্গুমেন্ট তৈরি করি ,আর সে অনুযায়ী একেকটা সূত্র তৈরি হয় আর আমরা সেসব সূত্র ব্যবহার করি। প্রসঙ্গগতভাবে একটা প্রশ্ন জাগে যে “পদার্থবিজ্ঞান জানতে বা বুঝতে হলে দর্শন কি আবশ্যক?”
এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায় কোনো বিষয় সেটা যাইই হোক না কেন সঠিকভাবে বুঝতে হলে সে বিষয়ের দর্শন বোঝাটা অপরিহার্য। দর্শন যদি আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয় তবে নিশ্চিতভাবে বিষয়টির গভীরে যাওয়াটা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। তো মূলত এই লিখাটার মাধ্যমে বেশ কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা থাকবে, পদার্থবিজ্ঞান কেন জরুরি,পদার্থবিজ্ঞান জানতে দর্শন কেন জরুরি, পদার্থবিদরা কি দার্শনিক ছিলেন কিম্বা দর্শন আর পদার্থবিজ্ঞান জেনে বা পড়ে আমার লাভ কি? প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও লিখার মধ্যে দেয়ার চেষ্টা করবো। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রবার্ট থর্নটন পুয়ের্টো রিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে শিক্ষকতার সুযোগ পান। মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তার পিএইচডি থিসিস পেপার করেন পদার্থবিদযার যুক্তি আর মেথডলজি প্রসঙ্গে । তো সেই থিসিস পেপারে তিনি মেথডলজির কিছু উদ্ভাবন করেন এবং প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে এই উদ্ভাবন সম্পর্কে তাঁর (আইনস্টাইন) কলিগদের জানানোর জন্য রাজি করাতে একটা চিঠি লিখেন থর্নটন।এই চিঠির উত্তরে আইনস্টাইন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করেন ,
“….A knowledge of the historic and philosophical background gives that that kind of independence from prejudices of his generation from which most scientists are suffering. This independence created by philosophical insight is-in my opinion-the mark of distinction between a mere artisan or specialist and a real seeker after truth.”
আইনস্টাইনের এই মন্তব্য অনুযায়ী স্পেশালিস্ট আর সত্যান্বেষীর মধ্যে পার্থক্য তৈরিকারি ফ্যাক্টরটা হলো দার্শনিক সূক্ষ্মদৃষ্টি। এই জিনিসটা আইনস্টাইন প্রায় তিরিশ বছর ধরে বলে গেছেন। হয়তো এই দার্শনিক সূক্ষ্মদৃষ্টিই তাঁকে আজকের আইনস্টাইন বানিয়েছে,বানিয়েছে এক মহান বিজ্ঞানী। তিনি মনে করতেন একটা দার্শনিক সত্তা একজন পদার্থবিদকে আরো ভালো পদার্থবিদে পরিণত করে। ১৯৩৬ সালে আইনস্টাইন ‘পদার্থবিজ্ঞান এবং বাস্তবতা’ এই শিরোনামে একটা আর্টিকেল লিখেন যার কিছু অংশ অনুবাদ করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায়,
“এটা প্রায় সময় বলা হয়,এবং অবশ্যই ন্যায্যতা প্রতিপাদন ছাড়া নয়,যে, বিজ্ঞানের মানুষ সাধারণত দুর্বল দার্শনিক। তাহলে পদার্থবিদদের কেন দার্শনিকদের হাতে দার্শনিক দৃষ্টিতে বিচার করার কাজটা ছেড়ে দেয়া সঠিক নয়? অবশ্য এটা সে সময়ে সঠিক কাজ হবে যখন একজন পদার্থবিদ বিশ্বাস করবেন যে তাঁর নিয়ন্ত্রণ আছে এরকম দৃঢ় প্রদ্ধতির মৌলিক ধারণা এবং মৌলিক বিধি আছে যেটা সন্দেহের দ্বারা পরিবর্তিত হবে না।তবে সেটা এখনের মতো সময়, যখন পদার্থবিজ্ঞানের ভিত যখন নিজেই সমস্যার মধ্যে আছে তখন সঠিক নয়। বর্তমানের মত সময়ে যখন অভিজ্ঞতা আমাদের বলপ্রয়োগ করে নতুন এবং দৃঢ় ভিত চাইতে ,পদার্থবিদরা সহজেই তাত্ত্বিক ভিতের সমালোচনামূলক চিন্তার জন্য দার্শনিকদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে পারে না; সে নিজেই ভালো জানতে এবং অনুভব করতে পারবে কোনটি সঠিক। নতুন ভিতের সন্ধানে তাঁর ধারণাগুলো কতটা সমর্থনযোগ্য এবং প্রয়োজনীয় সে ব্যাপারে তাঁকে অবশ্যই তাঁর মনকে পরিষ্কার রাখতে হবে”।
আইনস্টাইনের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত এই লাইনগুলোর বিশ্লেষণ বলে যে পদার্থবিজ্ঞান এখনো কোনো শক্ত ভিতকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যেতে যেহেতু পারছে না অতএব নিত্যদিন এখানে নতুন নতুন ধারণার জন্ম হবে।এসব ধারণাগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সেটা নির্ভর করবে চিন্তার গভীরতার উপর।আর এই চিন্তার গভীরতার জন্য প্রয়োজন দার্শনিক পদ্ধতি। এহেন অবস্থায় ধার করা দর্শন দিয়ে যেহেতু কাজ হবে না অতএব প্রত্যেক পদার্থবিদের দার্শনিক হয়ে উঠাটা আবশ্যিক।কেননা তারা দার্শনিক হয়ে উঠতে পারলেই তবে পদার্থবিজ্ঞান আরো শক্ত এবং দৃঢ় একটা ভিত পাবে
,যেটা জগতের সকল ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম।
পরবর্তী পয়েন্টে যাওয়ার আগে আমাদের আলোচনা করা উচিত গণিত নিয়ে।গণিত
হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষা। সেই ভাষা কি আমাদের দর্শনের দিকে ধাবিত করে? গণিত কি?
রিচার্ড ফাইনম্যানের একটা উক্তি দেয়া যায় এর জবাবে,
“Mathematics is a language plus reasoning; it is like a language plus logic. Mathematics is a tool for reasoning.”
তো একি ফাঁকে যুক্তি নিয়ে কিছু কথা বলে ফেলা যাক। লজিককে
সাধারণত ফরম্যাল তখনই ধরা হয় যখন সেটা একটা আর্গুমেন্টের বিশ্লেষণ করে কিংবা সেই
আর্গুমেন্টটাকে রিপ্রেজেন্ট করে। গণিতে মূলত আমরা মডেল থিওরি,প্রুফ থিওরি , সেট
থিওরি রিকার্শন থিওরিতে লজিক পাই। গণিত মূলত বিজ্ঞানের ভাষা। আর গণিত দর্শনের
গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘লজিক’ কে ধারণ করে। ফাইনম্যানের উক্তিটা বিশ্লেষণ করলেই আসলে
সেটা বোঝা যায়। গণিত যুক্তিবিদ্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ টুল। অতএব আমরা এখন পর্যন্ত
আর্গুমেন্ট,লজিক,রিজনিং এসব দিক বিষয়ের বিবেচনায় পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে দর্শনের
উপাদানগুলো খুঁজে পাচ্ছি।
সায়েন্টিফিক আমেরিকানের একটা আর্টিকেলে কার্লো রেভেলি উল্লেখ করেছেন এভাবে যে,আসলে পদার্থবিজ্ঞানে দর্শনের অবদান আমরা যতটা কল্পনা করি তারচেয়েও অনেক বেশি। যদিওবা বর্তমানে ‘এন্টি-ফিলসফিকাল’ একটা আদর্শ তৈরি হচ্ছে।তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এই আদর্শ বিজ্ঞান কিম্বা পদার্থবিজ্ঞানের উর্বরতা নষ্ট করছে।প্রাচিন গ্রিসে প্লাতো আর তাঁর আকাদেমি এই ‘ফিলসফি’র প্রচারে বড় অবদান রাখে। প্লাতো বা আকাদেমি মানুষকে প্রশ্ন করার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী ছিলেন। যার ফলাফলস্বরূপ আকাদেমি থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বেরিয়ে আসে। প্লাতোর পর এরিস্টটল সেই ধারা বজায় রাখেন এবন ‘এরিস্টটলিয়ান ফিজিক্স’ এর উদ্ভব ঘটান।এরিস্টটল মূলত প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু মৌলিক প্রশ্ন করে
গেছেন।পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে তিনি একটি তত্ত্ব দিয়ে গেছেন যেটি পরবর্তীতে
গ্যালিলিও দ্বারা খন্ডিত হয়।এরিস্টটলই বোধ হয় পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে প্রভাব রাখা
সর্বপ্রথম দার্শনিক ছিলেন। আবার, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান দর্শনের ফলাফল মূলত। গ্রহঅগুলোর বেগ থেকে ধরে, চন্দ্র-সূর্য কিম্বা গ্রহের কক্ষপথ সংক্রান্ত ধারণাগুলো দর্শনের কিছু প্রশ্নের উপর ভিত্তি করেই বের করা হয়েছে। আমরা জানি জ্যামিতিতে অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন ইউক্লিড।
ইউক্লিডের জ্যামিতিতে এই অবদান রাখার পেছনে প্লাতোর আকাদেমির গুরুত্বপূর্ণ একটা
ভূমিকা আছে।সেটা হলো এরিস্টটল ইউক্লিডকে জ্যামিতির ক্ষেত্রেও স্বতঃসিদ্ধ
যুক্তিবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত করেছেন। প্লাতোর আকাদেমির করে যাওয়া কিছু প্রশ্নই গ্যালিলিওর কাজকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে কিম্বা দিশা দেখিয়েছে। একইভাবে আমরা যদি নিউটনের দিকে তাকাই তাহলেও একই কথা বলতে পারি,
নিউটন নিজে প্রাচীন দর্শনের কাছে তাঁর ঋণের কথা স্বীকার করে গেছেন।বিশেষভাবে ডেমোক্রিটাসের কাছে।পরমাণুবাদ কিম্বা প্রাকৃতিক সরলরৈখিক গতি এসবকিছু দর্শনের কিছু প্রশ্ন থেকেই উৎপত্তি ঘটেছে। আবার যদি চলে আসি বিংশ শতাব্দিতে , তাহলে বলা যায় বিংশ শতাব্দিতে পদার্থবিজ্ঞানের উন্নতির মাত্রা অন্য যেকোনো শতাব্দির চেয়ে অনেক বেশি ।কেননা এ সময়ে বিজ্ঞানীরা ‘ফিলোসফাইজিং’ এর দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় হাইজেনবার্গের ‘অনিশ্চয়তা নীতি’
র কথা।কোয়ান্টাম মেকানিক্সে একটা কণার অবস্থান বা ভরবেগ যে একত্রে নির্ণয় করা যায় না সে কথা বলেছেন হাইজেনবার্গ। এই অনিশ্চয়তা নীতি নিজেই একটা দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবীদার হতে পারে।হাইজেনবার্গ নিজেই বিশ্বাস করতেন যে ,একজন ব্যক্তি দৃশ্যমান সীমার মধ্যে থেকেই জ্ঞান অর্জন করতে পারে।কোয়ান্টাম থিওরির উপর তাঁর করা ১৯২৫ সালের পেপারের এবস্ট্রাক্টে তিনি এভাবে উল্লেখ করেন যে ,
“The aim of this work is to set the basis for a theory of quantum mechanics based exclusively on relations between quantities that are in principle observable.”
প্রাথমিকভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য পরিমাপসমূহের উপর সম্পর্ক
স্থাপনের জন্য তিনি এই কাজটি করেন। পদার্থবিজ্ঞান আর দর্শনের মধ্যে মেলবন্ধনকারী
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইনের সকল কাজের
মধ্যেই দর্শনের একটা ছাপ বিদ্যমান।
স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে এই দর্শন ব্যাপকভাবে কাজ করে, তবে আইনস্টাইনের
সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন কাজ জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি অনেকটা তাঁর দার্শনিক
দূরদর্শিতার ফলাফল। এই কাজের জন্য তিনি বেশ কিছু দার্শনিকের কাছে ঋণী ছিলেন। মাখ
এবং পয়েনকারে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মজার বিষয় হলো,পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের কাতারে থাকা আইনস্টাইন
নিজে বিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের তিনটা ‘ক্রিটিক’ মাত্র ১৫ বছর বয়সে পড়ে
শেষ করে ফেলেন। তাই তাঁর মধ্যে দর্শনের প্রতি আনুগত্য কিম্বা দর্শনের প্রয়োজনীয়তা
অনুভব করাটা অস্বাভাবিক ছিলো না।
হকিং কিম্বা ওয়াইনবার্গের মত কিছু বড় বিজ্ঞানী অবশ্য দর্শনের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। তাঁদের এই
বিরুদ্ধবাতকে অবশ্য এরিস্টটলের একটা আর্গুমেন্ট দিয়েই কাউন্টার দেয়া যায়।সেটা হল, Those
who deny the utility of philosophy, are doing philosophy। মানুষের
জীবন আসলে দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং
জীবন দর্শন দ্বারাই পরিবেষ্টিত।অতএব একটি
দর্শনকে খারিজ করতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে আরেকটা দর্শনের উদ্ভব জরুরি হয়ে
উঠে। ফিজিক্স শব্দটার উৎপত্তি গ্রীক ‘ফুঁসিস’ যার অর্থ ‘প্রকৃতি’ কিম্বা ‘ফুঁসিকে’
যার অর্থ ‘প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান’ থেকে। প্রকৃতি সম্পর্কে নিবিড়ভাবে কোনো আলোচনা
চালাতে গেলে তাই পদার্থবিজ্ঞানের দরকার।আরো দরকার দর্শনের। আধুনিক বিজ্ঞানের
জন্মলাভের আগে পদার্থবিজ্ঞান আলোচনাই করা হতো দর্শনশাস্ত্রের মধ্য থেকে। আগেই
বলেছি জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা,শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানই নয় পদার্থবিজ্ঞানের অন্য অনেক
শাখাতেই দর্শনের পরিষ্কার ছাপ পাওয়া যায়। আইনস্টাইন,শ্রোডিঞ্জার ,কিংবা
হাইজেনবার্গের মধ্যে সেই দর্শনটারই রূপ পাওয়া যায়। এরিস্টটল,প্লাতো,কোপার্নিকাস
এঁদের রেখে বা এঁদের দর্শনকে বাদ দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিনই।
এতক্ষণ পর্যন্ত যা লিখলাম এরপরেও অনেকেই আমাকে খারিজ করে
বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের দোহাই দিয়ে পদার্থবিজ্ঞান আর দর্শনকে একই সুতায় বাঁধার
অপরাধে অনেকেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতেই পারেন।বলতে পারেন যে,কেন এই উপমহাদেশে বা
বাংলাদেশে যেসকল পদার্থবিজ্ঞানীর উত্থান ঘটেছে তাঁরা কি দর্শনের ব্যাপারে মনোযোগী
ছিলেন? আমার উত্তর হবে ইতিহাস ঘাটুন,ইতিহাস কথা বলবে।কার কথা বলবেন? সত্যেন বোস?
মেঘনাদ সাহা? জামাল নজরুল ইসলাম? প্রত্যেকেই অনেক উঁচু মাপের দার্শনিক ছিলেন।
জামাল নজরুল ইসলামের কথাই বলি প্রথমে।
মহাবিশ্বের অধ্যয়ন মোটা দাগে অনন্য এক অভিজ্ঞতা। অন্তত: এক দিক থেকে এটা সামগ্রিকতাকে বোঝার একটা প্রয়াস। আমরা, চিন্তাশীল সত্ত্বার অধিকারীরা নিউট্রন তারকা আর শ্বেত বামনদের নিয়ে গঠিত এই মহাবিশ্বের অংশ, এবং আমাদের গন্তব্য অনুদ্ধরণীয়ভাবে এই মহাবিশ্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
-----------দা আল্টিমেট ফেইট অব দা ইউনিভার্স।
আল্টিমেট ফেইট অব দা ইউনিভার্স বইয়ের এই ক’টা লাইনই যথেষ্ট
জামাল নজরুল ইসলামের দর্শন বোঝার জন্য। আমাদের জ্ঞানের সামগ্রিকতাকে তিনি
সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের মতো বলেছেন। জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন রবীন্দ্রনাথের
মানবীয় দর্শনে বিশ্বাসী।কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রসঙ্গ টেনে আনতেন। “বিজ্ঞান,দর্শন,ধর্ম ও আইডিওলজি “ প্রবন্ধের শেষে তিনি লিখেছেন,
“ আমি কতকগুলি উদ্ধৃতি দিয়ে এই প্রবন্ধটি শেষ করতে চাই,যেগুলি বিজ্ঞানের শান্ত,নম্র ও চিন্তাশীল দিকগুলি ব্যাখ্যা করে এবং যেগুলো মানবজাতির সত্যের ও জ্ঞানের সন্ধান ও চর্চার প্রতীকস্বরূপ দেখা যায়।আমি এই দিকটিকে প্রযুক্তি ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানের চেয়ে কোনো অনবগশে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনা। এবং এর বিরাট সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক দিকের গুরুত্ব রয়েছে। একই কারণে আমাদের চারুকলা ও ও শিল্পকলার সব ধরণের কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন,কারণ এগুলি মানুষের অদম্য সত্তার গভীরতম বহিঃপ্রকাশের মধ্যে গণ্য”
কিম্বা কখনো তাঁকে দর্শনে মগ্ন থেকে পাওয়া যেতো বাহাদুর শাহ
জাফরের গজল গাইতে,
“ উমর ই দরাজ মাঙ্গ কার লায়ে থে চারদিন/ দো আরজু মে কাট গায়ে,দো ইন্তেজার মে।( আমি চারদিনের আয়ু খুঁজে নিয়ে এসেছিলাম ,দুইদিন কেটেছিল আশায় ,দুইদিন অপেক্ষায়”)
এই সকল উদ্ধৃতিই আসলে অধ্যাপক ইসলামকে ব্যাখ্যা করার জন্য
যথেষ্ট।
এবার আসি মেঘনাদ সাহার প্রসঙ্গে। এই মহান পদার্থবিদের ধারণা
একদম পরিষ্কার। তিনি মনে করতেন ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতীয়দের রক্ষা করার একটাই
উপায় ।সেটা হলো বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার। তাই তিনি নিজেই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন
বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করার ব্যাপারে। বি পি আধারকারের লিখা ‘ওয়ার কামস’
বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনি তাঁর দার্শনিক সত্তার পরিচয় প্রদান করেন। মেঘনাদ
সাহা নিজে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। স্কুল থেকে একবার বরখাস্ত ও হতে
হয়েছিলো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার জন্য। ব্যক্তিগত জীবনে চর্চা করতেন
মানবতাবাদী দর্শনের।গাণিতিক যুক্তিবিদ্যা আর দর্শনে ছিলো আগ্রহ। একই বিষয় ঘটে
তাঁরই সহপাঠী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ক্ষেত্রে ,যিনি সত্যেন বোস নামেই অধিক
পরিচিত।মহাবিশ্বের অর্ধেক কণা যার নামে মাথানত করে সেই বোস পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম
এক পথিকৃৎ। বোসের ছিলো ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশুনা। সত্যেন বোসকে নিয়ে
তাঁর পৌত্র ফাল্গুনী সরকারের একটা সাক্ষাতকার থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। যেখানে
তাঁর বুদ্ধের দর্শনের প্রতি আগ্রহের কথা জানা যায়। প্রশ্ন হলো এ সকল বিজ্ঞানী আসলে
ঠিক কিভাবে পদার্থবিজ্ঞানের সাথে দর্শনের মেলবন্ধন করেছেন। প্রত্যেক বিজ্ঞানীর
স্বতন্ত্র কাজগুলোর দিকে দেখলে দেখবেন তাঁরা সকলেই গাণিতিক যুক্তিবিদ্যায় খুব বেশি
মাত্রায় আগ্রহী ছিলেন। গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো একটি ঘটনারে ব্যাখ্যা
তাঁরা দিতে চাইতেন। কি এবং কেন এই দুটি প্রশ্ন করে তাঁরা অনেক কঠিন সমস্যার
সমাধানে গেছেন। সত্যেন বোস একবার বলেছিলেন বিজ্ঞানের দর্শনকে তিনি প্রথমে অতটা
গুরুত্ব না দিলেও এটা আসলে বিজ্ঞানের থেকে আলাদা নয়। তাই তো হাইজেনবার্গের
অনিশ্চয়তা নীতি দিয়ে উত্তর-আধুনিকতার কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া হয়।আবার দর্শনের
অধিবিদ্যা নিয়েও অনেক পদার্থবিদ কাজ করে যাচ্ছেন।
এতসব আলোচনার একটাই উদ্দেশ্য পদার্থবিজ্ঞান পড়ার মূল
উদ্দেশ্য যদি না বোঝা যায় পদার্থবিজ্ঞান থেকে হতাশা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। এই
হতাশা থেকে উত্তরণের উপায় হলো পদার্থবিজ্ঞান কি সেটা ভালোভাবে জেনে ও বুঝে
পদার্থবিজ্ঞান পড়তে আসা। পদার্থবিজ্ঞান কেন পড়তে হবে এই প্রশ্নের জবাব আমার দেয়ার
প্রয়োজন তেমন একটা নেই, আমার আগেই অনেকেই দিয়ে গেছেন।তবে কিছু কথা তো যোগ করতেই
হয়। এই মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল।এর সাথে সম্প্রসারণশীল আমাদের চিন্তাচেতনা। এই
সম্প্রসারণশীল চিন্তা প্রতি মুহুর্তেই আমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন করে।এটা কি ,এটা
কেন? প্রকৃতির এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের জন্ম। পদার্থবিজ্ঞানই
মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে আত্মিক মেলবন্ধন ঘটাতে পারে।ছোট্ট একটা কণা থেকে ধরে
বিশাল এক নক্ষত্র সম্পর্কে যেকোনো রহস্যের সমাধান করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে
পদার্থবিজ্ঞান। আর সেই অগ্রযাত্রায় ‘কি এবং কেন’ এই প্রশ্নগুলোই তৈরি করে দিচ্ছে
পদার্থবিদ্যার নতুন এক দর্শন। পদার্থবিদ্যার বিস্তৃতি তাই অসীম। আর সেই অসীম
বিস্তৃতিতে পদার্থবিদ্যাকে প্রতিমুহুর্তে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে দর্শন। বিখ্যাত
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের মতোই বলতে হয়,
“ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে দর্শন ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ,যতটা পাখিদের কাছে পক্ষীতত্ত্ববিদ্যা”
সম্প্রসারিত মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীল চিন্তাগুলো নিয়েই
এগিয়ে যাই আমরা......
তথ্যসূত্রঃ
১। Albert Einstein as
a philosopher of science, Don A Howard
২। Physics need Philosophy, Philosophy need Physics, Carlo
Rovelli.
৩। ফাল্গুনী সরকারের সাক্ষাৎকার
৪। শিল্প,সাহিত্য ও সমাজ-জামাল নজরুল ইসলাম
৫। মেঘনাদ সাহাঃজীবন ও সাধনা- সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র
Comments
Post a Comment