পর্যালোচনাঃমুক্তির গান





‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্য-চলচ্চিত্রের শুরুটা হয় ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়ে। তারেক মাসুদ এখানে খুব সুন্দর একটা চাতুর্য দেখিয়েছেন। ভাষণের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এ অংশটুকু ব্যবহার করেছেন তারেক। সামগ্রিক মুক্তি ব্যতীত স্বাধীনতার মূল্য খুবই কম। একাত্তরে আমাদের সামগ্রিক মুক্তির প্রয়োজন ছিলো, সেটা রাজনৈতিক,সেটা অর্থনৈতিক,সেটা সাংস্কৃতিক। তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এ মুক্তির সংগ্রামের অংশটুকু থেকেই তারেক মাসুদের মুক্তির গানের শুরু। তারেক শুরুতেই আরেক অনবদ্য সৃষ্টি ‘স্টপ জেনোসাইড’ এর একটা ফুটেজ ব্যবহার করেন। মুক্তির গানের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দিক ছিলো তার  নির্মাণশৈলী। লিয়ার লেভিনের ফুটেজগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে ছিলো।লেভিনের ২২ ঘন্টার সেই ফুটেজের কোন অংশটুকু রাখাযায় আর কোন অংশটুকু বাদ দিতে হবে সে জ্ঞান তারেকের ছিলো।শরনার্থী শিবিরে  ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সদস্যরা গান শুনিয়ে বেড়াতো, পারফর্ম করে বেড়াতো। গল্প কথক তারিক আলীর বয়ানে আমরা শুনি, “…. তারা আসছে আশা স্বপ্ন সব পিছনে ফেলে।কেন? আমি নিজেকে প্রশ্ন করি। তারা নিজেদের পছন্দমতো কাউকে ভোট দিয়েছিলো বলে?এখন তারা উদ্বাস্তু,নজিরবিহীন এক গণহত্যার শিকার”। তারিক আলীর এ প্রশ্নটা সবার! তারিক আলী যখন এ বর্ণনা করে যাচ্ছে পেছনে আরো একটি বর্ণনাও চলতে থাকে,

              “দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখ গান গাহিয়ে
          নগরে প্রান্তরে বনে বনে ।  অশ্রু ঝরে দু নয়নে,
              পাষাণ হৃদয় কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে ।“

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার ১১৭ জন সদস্যের অভিজ্ঞতার কথা এ গান। মাহমুদুর রহমান বেনুর ১১ জনের দলের মনের কথা রবীন্দ্রনাথের এ সৃষ্টি! কি অদ্ভুতভাবে যেন মিলে যায়! পরের দৃশ্যেই দেখা যায় শরনার্থী শিবিরের মানবেতর জীবন দেখাতে দেখাতে ‘এই না বাংলাদেশের গান’ শুরু হয়। বিপুল ভট্টাচার্যের এই গানটার সাথে ফুটেজগুলো কি সুন্দরভাবে যে মিলে যায়!

‘নদীর দেশ এই বাংলাদেশ ভাই সবুজ মায়ায় ভরা,
আর আজ পদ্মা-মেঘনা-যমুনাতে বহে রক্তের ধারারে দয়াল,
দুঃখে আমার পরাণ কান্দেরে”।

একদিকে গানের এ অংশ চলে অন্যদিকে দৃশ্যে আমরা দেখি সবুজ শ্যামল নদীর বাংলাদেশ যেখানে পরক্ষণেই আমরা দেখি নদীতে অগণিত লাশ আর রক্ত। এরপরে আবার আমরা শুনতে পাই,

“কত সাধের ছাওয়াল আমার রাস্তায় পইড়া মরে,
শকুনের দল ছিড়িয়া খায় বাঁচায় না কেউ তারে দয়াল”

 পেছনে এ গান চলে আর দৃশ্যে আমরা দেখি অগণিত লাশ পড়ে আছে,আর শকুনের দল সে লাশ দেখে একত্রিত হয়েছে। লেভিনের এ দৃশ্য ধারণে অবশ্য তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। এদৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে তাঁকে দুদিনের হাজতবাস করতে হয়। তবে তার এই ধারণকৃত দৃশ্য একটা দলিল হয়ে রয়ে গেলো শেষ পর্যন্ত। তারেক মাসুদের রবীন্দ্রসংগীত আর লোকগীতি ব্যবহার করার এ ধরণটা বেশ চমৎকার। ‘দেশে দেশে ভ্রমি’ যখন সে ব্যবহার করে তখন দেখা যায় শিল্পী সংস্থার ট্রাক কলকাতার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গান গাচ্ছে। আবার ‘এই না বাংলাদেশের গান’ যখন চলছে তখন আমরা একদিকে দিকে বাংলার সৌন্দর্য বর্ণনা ,আরেকদিকে দেখি বীভৎসতার বর্ণনা। একদিকে সবুজ প্রকৃতি আরেকদিকে অগণিত লাশ আর লাল রক্ত। আহা লাল সবুজে মিলে এই না বাংলাদেশের গান!

তারেক মাসুদের এই প্রামাণ্য-চলচ্চিত্রের সুন্দর দিকটি হলো ,তারেক এইখানে সব মানুষের কথা তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। ‘কিষাণ মজুর বাংলার সাথি’ গানটার মাধ্যমে যুদ্ধে কৃষক-শ্রমিকদের অবদান কতটা ছিলো সেটা তুলে ধরেছেন।এই গানের কথায় আছে, “তোমার হাতে দেশের কাঠি,হবে রে হবে জয়”। মুক্তিযুদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর ছিলো না,সেটা ছিলো সব শ্রেণী-পেশার মানুষের। সার্বজনীনতা ছিলো সেই যুদ্ধে, সকলেরই প্রয়োজন ছিলো মুক্তির। একটা দৃশ্যে আমরা দেখি যখন শিল্পীরা শরনার্থী শিবিরের একজন লোকের সাথে কথা বলছে, তিনি শিল্পীদের বলছেন যে কেউ ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করতে পারবে না। তারেক এই দৃশ্যটাকে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন।এই অংশটুকুর পরেই আমরা দেখি তারিক আলী শরনার্থী শিবির থেকে যাওয়ার সময় একটা টিয়া পাখি নিয়ে যায়,আর টিয়াটিকে ‘জয় বাংলা ,জয় বাংলা’ শেখানোর চেষ্টা করে। শিল্পীরা যখন শরনার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে বেড়াইয় তখনকার শিবিরের কিছু ফুটেজ ধারণ করেন করেন লেভিন। দেখা যায় তারিক আলী বলছে যে তাঁদের মতো কিছু তরুণ উদ্যোগ নিয়ে শিবিরগুলোতে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করছে। কিন্তু তাতেও যেন হয় না, প্রতিদিনঅই রোগীর সংখ্যা,আহতের সংখ্যা  বাড়তে থাকে। আহত অনেক মুক্তিযোদ্ধাও সেখানে আসছে।
তারেক শিল্পীদের মনে কি চলছে সেটা তুলে আনতেও কার্পণ্য করেন নি! একটা দৃশ্যে দেখা যায় শিল্পীরা কয়েকজন রেওয়াজ করছেন  ,আর কয়েকজন পত্রিকা পড়ছেন। সেখানেই তাঁদের মধ্যে কি চলছে সে নিয়ে আলাপ! কারো বাবা যুদ্ধে তো কারো ছোটো ভাই। রেওয়াজ কিন্তু থেমে থাকে না। এরপরেই শিল্পীদের এ বিষণ্নতা আর নস্টালজিয়াকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তারেক বাঁশির একটা ইন্সট্রুমেন্টাল রাখেন। সেটা ছিলো,
  “এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী।

ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনি॥

রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,

আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল”
নজরুলের এ গানটি মূলত তারেক ব্যবহার করেছিলেন দুটি কারণে। প্রথমত, শিল্পীদের বিষণ্নতা আর নস্টালজিয়া বুঝানোর জন্য। আর দ্বিতীয়ত ,নজরুলের গান/কবিতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। অতএব নজরুলের একটা গান এ প্রামাণ্যচিত্রে না থাকলে তা অসম্পূর্ণ হবে। এ দৃশ্যের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে হয়। লিয়ার লেভিনের মূল যে ফুটেজটি ছিলো সেখানে বেণু ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গাচ্ছিলো ট্রেনে। আর বাকি শিল্পীরাও গলা মিলাচ্ছিলো। কিন্তু ১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি মাস যেহেতু যুদ্ধের মধ্যে পড়ে নি সেহেতু তারেকের কাছে মনে হয়েছিলো এ অংশটুকু রাখলে সেটা অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে।তাই ট্রেনের অংশটি সে রাখে ,কিন্তু বাঁশির সুরে, ‘কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিণু ‘ দিয়ে। এরপরেই আবার দেখা যায় ,শিল্পীরা খুব আগ্রহের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর শুনছে। যুদ্ধের কি অবস্থা, মুক্তিবাহিনী কোথায় কোথায় আক্রমণ করেছে আর কোন কোন অঞ্চল মুক্ত করেছে তা বলা হচ্ছে খবরে। এটাই যেন শরনার্থী শিবিরগুলোতে দিনশেষে সকল শরনার্থীর নিত্তনৈমিত্তিক কাজ। যুদ্ধের কি অবস্থা, তাঁর বাবা-ভাই-বোন-মায়ের কি অবস্থা সেটা জানার আগ্রহে একটাবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ শুনতেই হবে। শিল্পীরাও তাই সে সংবাদ শুনে আর গাইতে থাকে রবি ঠাকুরের ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’,

      “ওগো        মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
      তোমার     দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে”॥


সবুজ একটা ধানক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে এক কৃষকের সঙ্গে জোর তর্ক চলছে একজন রাজাকার আর খোদ ইয়াহিয়া খানের।
রাজাকার: কইয়া দাও, মুক্তি কোথায়?
ইয়াহিয়া: কিধার মুক্তি হায়?
কৃষকটি একটু এগিয়ে এসে নিজের বুক চাপড়ে বলল, এইখানে, এইখানে থাকে মুক্তি। বুকের মধ্যেই মুক্তি থাকে।
উপরের তর্কটা চলছে পুতুলদের মধ্যে। ‘একাত্তরের পুতুলওয়ালা’র কথা মনে আছে? হ্যাঁ মুস্তফা মনোয়ারের কথা বলছি। পুতুলদের এই কথাগুলো সাজিয়েছেন তিনি। শরনার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে পাপেট শো দেখাতেন মুস্তফা মনোয়ার। আর এতেই মুখে হাসি ফুটত ক্যাম্পের শরনার্থী আর রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের। বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় যখন আসছিলেন মুস্তফা মনোয়ার রাস্তায় দেখলেন অসহায়ত্ব,সবার মুখ মলিন,কলকাতাতেও একই অবস্থা। সিদ্ধান্ত নিলেন এদের মুখে হাসি ফোটাবেন। শুরু হলো পুতুলের যুদ্ধ! রাজাকার এসে গ্রামের লোকজনকে ভয় দেখাচ্ছে,চলে এসেছে খোদ ইয়াহিয়াও। পিছন পিছন আসে মুক্তিযোদ্ধারা। এসেই পেটায় রাজাকার আর ইয়াহিয়াকে। এ দেখেই শরনার্থী শিবিরের সকলের মুখে হাসি। সন্তান হারানো মায়ের বুকে, বাবা-ভাই হারানো মেয়ের মুখে, কিংবা ছোট্টো শিশুর মুখে। এই তো চেয়েছিলেন মুস্তফা। এই পাপেট শোর আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করেন তারিক আলী আর সাইদুল আনাম টুটুল। লিয়ার লেভিন এই পাপেট দেখে খুবই আকৃষ্ট হন। দৃশ্যগুলো ধরে ফেলেন ক্যামেরাতে। আর সেই দৃশ্য থেকেই হয়ে যায় ‘মুক্তির গান’ । তারেক মাসুদ যখন ‘মুক্তির গানে’ পাপেট শোর অন্তর্ভুক্তির কথা বলেন,আর রেকর্ডিং এর জন্য মুস্তফা মনোয়ারের কাছে যান, মুস্তফা মনোয়ার তখন কেঁদে ফেলেন। আরো একজন কাঁদেন , তাঁর কথা আমরা পরে বলবো।
শিল্পীদের মনে একটা সময়ে মুক্তাঞ্চলে, স্বাধীন বাংলাদেশে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটির স্বাদ নেয়ার ইছে জাগে। একটা সময়ে সে সুযোগটা আসে, তাঁরা রওনা দেন মুক্তাঞ্চলের দিকে। এই জায়গাতে তারেক একটা দৃশ্য ব্যবহার করেন, তারিক আলী ধারাভাষ্য করছে, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে সীমান্ত অঞ্চলে,আর নিচে একটা ফলকে, ‘ওয়েলকাম টু ইস্ট পাকিস্তান’ লিখা। যেখানে ইস্ট পাকিস্তান শব্দগুলো মুছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপরেই যখন শিল্পীরা নৌকায় করে মুক্তাঞ্চলে প্রবেশ করে,আমরা দেখি ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজছে। মুক্তাঞ্চলে শিল্পীরা পরিচিত হয় মেজর গিয়াসের সাথে,যিনি ছিলেন গেরিলা কমাণ্ড্যার। লেভিনের ফুটেজে আমরা গেরিলা ট্রেনিং এর একটা অংশ দেখতে পাই। যেখানে মেজর গিয়াস গেরিলাদের বিভিন্ন উপদেশ আর নির্দেশনা দিছিলেন। আর তারিক আলীর মনে একটা আত্মবোধের জন্ম হয়, শুধু শিল্পী হয়ে তিনি থাকতে চান নি,হতে চেয়েছেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। আর এইজন্য তিনি গিয়েছিলেন মেজর গিয়াসের কাছে। মেজর গিয়াস তাঁর স্পিরিটটা বুঝতে পারলেও কিছু জটিলতার জন্য তাঁকে তৎক্ষণাৎ দলে নিতে পারেন নি। একটা দৃশ্যে আমরা দেখি গেরিলা যোদ্ধারা যুদ্ধ করে ফিরে আসে আর শিল্পীরা তাঁদের গান শোনায়, ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ । যুদ্ধের সময় গেরিলা যোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহারেরও সুন্দর একটা ফুটেজ আমরা দেখতে পাই। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার মনেই যেন একটা স্পিরিট খেলা করছিল,

  ভাইয়ের মায়ের এতো স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ,
ও মা তোমার চরণ দুটি বুকে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি”।   


“এ ক্যাম্পের কয়েক টুকরো বাঁশ বেঁধে দুজনকে আনা হয়েছে, একজনের আঘাত গুরুতর,আরেকজনের আঘাত কিছুটা কম। গুরুতর আহত লোকটি যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে বললেন, ডাক্তারবাবু আমি বাঁচব না,আমার চিকিৎসার দরকার নেই। ও বাঁচবে,ওকে দেখুন ,ও লড়বে। ডাক্তারবাবুর চোখে জল চিকচিক করে উঠলো। কত মৃত্যুই না তিনি দেখলেন!”

একাত্তরের যুদ্ধে রেডিও ছিলো একটা অনুপ্রেরণার উৎস। সেটা হোক স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের কোনো অনুষ্ঠান,হোক চরমপত্র, কিম্বা আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমা। আকাশ বাণীতে সংবাদ পাঠ করতেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে দিয়েই তারেক এই চলচ্চিত্রের জন্য উপরের অংশটুকুর ভয়েজ ওভার নেন। আর জুড়ে দেন লেভিনের অসাধারণ একটা ফুটেজের সাথে। ফুটেজটিতে লেভিন যেন ধারণ করেছিলেন সাত কোটি মানুষের ভাবনাকে। যোদ্ধারা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছিলো। সবাই ভাবছিলো, কেউ হয়ত পরিবারের কথা,কেউ হয়তো দেশের কথা। লেভিন সেই ভাবনাটুকুকে ধারণ করে ফেলেছিলেন। এই দৃশ্যটুকুর জন্য তারেককে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। আকাশবাণীর অফিসে যুদ্ধের সময়কার কোনো রেকর্ডিং পাওয়া যায় নি। সাধারণত বিশ বছর পর্যন্ত রেকর্ডিংগুলো সেইভ করে রাখা হয়। একটা দেশের মুক্তির সংগ্রামের এত বড় দলিল ২০ বছরেও যে কেউ সংগ্রহ করে রাখে নি এটা বড় ভাবার বিষয়! যাই হোক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বিকল্প একটা পথ দেখান। প্রণবেশ সেনের কাছে যেতে বলেন তারেককে।  প্রণবেশ সেন একাত্তরে আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমার স্ক্রিপ্ট লিখতেন। তারেক তাঁর সহযোগী জুনায়েদ হালিমকে পাঠান প্রণবেশ সেনের কাছে। প্রণবেশ সেন রীতিমতো কেঁদে ফেলেন জুনায়েদকে দেখে। তিনি আক্ষেপ করলেন,এতদিন কেউ তাঁদের খোঁজ নেয়নি বলে,কেউ আসে নি এই গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংগ্রহ করতে। জুনায়েদ হালিমের তত্ত্বাবধানেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ডিং এর কাজটি সম্পন্ন হয়। রেকর্ডিং শেষে তিনিও নিজেকে সামলে রাখতে পারেন নি। কেঁদে ফেলেন জুনায়েদ হালিমের সামনে এবং বলেন,তিনি যেন আবার একাত্তরে ফেরত গেলেন। এ জায়গাতে জুনায়েদ হালিমের কাজের কথা না তুললেই নয়। তারেকের এ প্রামাণ্য-চলচ্চিত্রে সকল ডকুমেন্ট বা ফুটেজ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি রাখেন জুনায়েদ হালিম। তারেক নিউইয়র্ক থাকার সময়ে দেশে সকল কাজ জুনায়েদকে দিয়েই করিয়ে নিয়েছিলেন।
‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ আর ‘যশোর খুলনা’ এই দুইটি গান অসাধারণভাবে ব্যবহার করেছেন তারেক। লেভিনের ফুটেজ থেকেই দেখা যায় ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ গানটার শেষদিকে গানের রিদমের উদ্দীপ্ততা কিভাবে যোদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়ে যায় সেটা দেখা যায়। গানের রিদমের সাথে মিলিয়ে যোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়াটা অসাধারণ এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। ‘যশোর খুলনা’ গানটিতে তারেক লেভিনের কোনো ফুটেজ ব্যবহার করেন নি। বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত আর কেনা ফুটেজ ব্যবহার করে এই গানটিকে সাজানো হয়েছিল। যুদ্ধের শেষদিকের একটা ফুটেজ দেখানোর সময় তারেক জাতিসংঘে ভুট্টোর একটা ফুটেজ দেখিয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে ১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভুট্টো যুদ্ধবিরতির চুক্তিপত্র ছিড়ে ফেলেন। এই দৃশ্যটি তারেক সংগ্রহ করেছিলেন জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা হাসান ফেরদৌস থেকে। দৃশ্যটির নাটকীয়তা রাখতে এরপরেই শিল্পীদের একটা গান রাখেন,আর এরপরেই দেখা যায় বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে সর্বস্তরের জনতা। 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ ছিলো গেরিলাযুদ্ধ। গেরিলারা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে আক্রমণ করতো,আর আক্রমণ করেই সেখান থেকে পালিয়ে যেতো। এটাই গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম। তারেক মাসুদের এই প্রামাণ্য-চলচ্চিত্রে আমরা গেরিলা যুদ্ধের কিছু দৃশ্য দেখতে পাই। তারেকের এই প্রামাণ-চলচ্চিত্রের প্রায় সব দৃশ্যই মুক্তিযুদ্ধেরই দৃশ্য। কিন্তু একটা দৃশ্য তারেক এই প্রামাণ্যচিত্রে যোগ না করে পারেন নি। সেটি হলো রাতের বেলা গেরিলা যোদ্ধাদের পানি কেটে গিয়ে আক্রমণ করার দৃশ্য। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরণের দৃশ্যের কোনো ফুটেজ পাওয়া সম্ভব না। বিশেষ করে রাতের বেলা এ ধরণের অপারেশনে তো একেবারেই না। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এ ধরণের ঘটনা অহরহই ঘটেছে ,তাই তারেক যেকোনোভাবেই এ ধরণের একটা দৃশ্য রাখতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মুশকিল হলো প্রফেশনাল অভিনেতাদের কারো অস্ত্র চালানোর অভিজ্ঞতা ছিলো না। তাই তাঁদের দিয়ে এ ধরণের দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব না, এদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও বয়সে আর তরুণ নেই,অথচ শটটা তরুণ যোদ্ধাদের। গেরিলা অপারেশনের এই অ্যামবুশ শ্যুট করার জন্য তারেক আর ক্যাথরিন দেশে আসেন। আর শ্যুটিঙটা করেন এলাকার ব্রেইভইয়ার্ড কিছু ছেলেকে দিয়ে, যারা সেরকম অর্থে কোনো অপরাধকর্মের সাথে যুক্ত নয়,অথচ এলাকার কোনো ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হলেই তা প্রতিরোধ করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই তরুণদের মধ্যে একটা স্পিরিট কাজ করছিলো,ঘন্টার পর ঘন্টা শীতের রাতে পানিতে নেমে শ্যুটিং করছে তাঁরা ,অথচ কারো কোনো অভিযোগ নেই, উলটো পাল্লা দিয়ে আসল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অসাধারণ একটা দৃশ্য শেষপর্যন্ত উপহার দেয়।

আগেই বলেছি ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্য-চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদের নির্মাণশৈলি চোখে পড়ার মতো। কিছু জায়গা সম্পাদনার টেবিলে তিনি সাজিয়েছেন। বেণুর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ থেকে ‘এ কি অপরূপ রূপে হেরিণু’ যেমন আমরা একদিকে পাই, তেমনি স্বপন চৌধুরীর কীর্তন থেকে ‘আমি দেশের ও লাগিয়া’ তে পাই। এই কীর্তনের আমেজটাকে ব্যবহার করে তারেক এই গানের মধ্যে রাজনৈতিক কিছু কথা ঢুকিয়ে দেন। আরেকটা জায়গায় সম্পাদনার কাজ অসাধারণ ছিলো। সেটি হলো কলকাতার কল্যাণী ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে তারিক আলী একটা শিষ বাজায় ,যেটা ছিলো চাইকোভস্কির কোনো সুর। তারেক এই জায়গাটাকে পরিবর্তন করে ‘জয় বাংলা,বাংলার জয়’ এর সুরটি বসিয়ে দেন। এই শিষটি তৈরি করেন সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় আর ক্যাথরিন মাসুদ। কল্যাণী ক্যাম্প থেকে ফেরত যাওয়ার এ দৃশ্যটি তারেক ব্যবহার করেন শিল্পীরা যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরছেন তা দেখানোর জন্য। যদিওবা প্রকৃতপক্ষে শিল্পীরা ডিসেম্বরে নয়,১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফেরেন। দৃশ্যের নাটকীয়তা বজায় রাখার জন্য তারেক এ কাজটি করেন। ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয়ের পর জনতার উল্লাসের কিছু দৃশ্য দেখা যায়। তারেক প্রামাণ্য-চলচ্চিত্রটি শেষ করেছেন তারিক আলীর কিছু কথার মাধ্যমে। তারিক আলী স্মৃতিচারণ করেন মুক্তিযোদ্ধাদের, আর প্রশ্ন রেখে যান শুধু স্মৃতিচারণেই কি দায়িত্ব শেষ? আমরা কি আদৌ পারবো এই আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে? আরো একটা প্রশ্ন তারেক মাসুদের মনে জন্মেছিল হয়তো। জন্মানোটাই স্বাভাবিক। লিয়ার লেভিনের ‘জয় বাংলা’ ফুটেজ যখন ‘মুক্তির গান’ এ পরিণত হচ্ছিল তখন কি বাঁধা তারেক পেয়েছিলো তিনি জানতেন। মুক্তির গানকে কোনো প্রেক্ষাগৃহ রাখে নি। নিজেদের উদ্যোগ নিয়ে শো দেখাতে হয়েছিল। তারেকের মনে কি প্রশ্ন কি জাগে নি? “মুক্তি আদৌ কি মিলেছে?”




Comments