রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশঃ ইচ্ছে বনাম নিয়মের গল্প
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ নাটকটি ইচ্ছে বনাম নিয়মের এক অদ্ভুত
মেলবন্ধন করে। রবীন্দ্রনাথ এ নাটকে যেন বারবার সমাজকেই ভাঙছেন, রাষ্ট্রকে ভাঙছেন। আর
নতুন করে গড়ে তুলছেন মানবিক,মুক্ত এক সমাজ। রবীন্দ্রনাথের এ নাটক শৃঙ্খলা আর নিয়মকে
ভাঙার নাটক। শৃঙখলমুক্ত জীবনই স্বাভাবিকতা-এ বাক্যকে বারবার প্রমাণ করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
আর তাই তাসের দেশ একদিকে যেমন ইচ্ছে আর নিয়মের এক দ্বন্দ্ব তৈরি করে অন্যদিকে মুক্ত
জীবনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। এই নাটকের গানগুলো যেন শেখল ভাঙার গান।
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট |
রবীন্দ্রনাথের
বিপ্লবী বার্তা
রবীন্দ্রনাথ এই নাটকটি উৎসর্গ করেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সুভাষচন্দ্র বসুকে। আর যে সময়ে রবীন্দ্রনাথ এ নাটক লিখছেন
তখন জার্মানিতে হিটলারের হাত ধরে আর ইতালিতে মুসোলিনীর হাত ধরে জন্ম নিচ্ছে ফ্যাসিবাদ।
হিটলার বা মুসোলিনীর একনায়কতন্ত্রের গল্প আমরা সকলেই জানি। ফ্যাসিবাদ আর নাজিবাদের
হাত ধরে বদলে যাচ্ছিল জার্মানি আর ইতালির সমাজ। এমন এক সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদকে
চরমভাবে আক্রান্ত করেন এই নাটক দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে মুক্তভাবে ছুটে বেড়ানোর
কথা বলেছেন। বলেছেন স্বাধীনভাবে গান গাওয়ার কথা। এসবই একটা কর্তৃত্ববাদী সমাজ আর শোষণবাদী
রাষ্ট্রের মুখে চপেটাঘাত। রবীন্দ্রনাথকে খোলা চোখে দেখতে গেলে সে অর্থে বিপ্লবী লেখক
হিসেবে হয়তো তেমন কেউ ব্যাখ্যা করতে রাজি হবেন না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই বিপ্লবী
বার্তা তাঁকে রবীন্দ্রনাথ করে তুলেছিল। আর তিনি হয়ে ওঠেছিলেন পুরো বিশ্বের কবি।
রাজপুত্রের
উৎপাত- শৃঙ্খলমুক্ত জীবনের গল্প
‘তাসের দেশ’ এর রাজপুত্রকে যখন রাজার সামনে হাজির করা হয় তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় অন্য রাজ্য থেকে তাসের দেশের জন্য
সে কি ভেট(উপঢৌকন) নিয়ে এসেছে। তখন রাজপুত্র জবাব এ রাজ্যে যা নেই আমি তা ই নিয়ে এসেছি, আমি উৎপাত নিয়ে
এসেছি। রবীন্দ্রনাথের এ নাটকটাতে নৈরাজ্যের চমৎকার রূপায়ন দেখা যায়। এই নৈরাজ্যকে
ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি বাতাসের মধ্যে। সেটা ছড়িয়ে যায় রাজপুত্র থেকে তাসেদের মধ্যে।
তাসগুলো নিয়মকে অমান্য করা শুরু করে। তারা এমন এক নৈরাজ্যের সমাজের চিন্তা করতে
থাকে যেখানে তারা মুক্তভাবে হেঁটে বেড়াতে পারে, পারে গান গাইতে, একে অপরকে
ভালবাসতে। এই নৈরাজ্য, শৃঙ্খলমুক্তিকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায় ক্ষমতার চাদরে লেপ্টে থাকা
কর্তৃত্ববাদীরা। তাই তারা ‘ডিসিপ্লিন ইজ লাইফ’ এই মূলমন্ত্রকে সভ্যতার মূলমন্ত্র
হিসেবে চালাতে চায়। অথচ ডিসিপ্লিন হলো দাসত্বের পরিমাপক। যে যতটা ডিসিপ্লিনড সে
ততটাই বড় দাস। কিন্তু মানুষ স্বভাবজাতভাবেই দাসত্ব পছন্দ করে না। সে ‘উৎপাত’ পছন্দ
করে। সে পছন্দ করে মুক্ত স্বাধীন বাতাস। রাজপুত্রের এই উৎপাত তাই আমাদের শৃঙ্খলমুক্ত জীবনের গল্পই বলে।
তাসের ঘরে হালকা হাওয়া
তাসের দেশের রাজা
সবচেয়ে বেশি ভয় পায় হাওয়াকে। হালকা হাওয়া। তাই সে সবসময়ই তাসের দেশকে গম্ভীর করে
রাখতে চায়। গোলাম যেমন বলে,
“ হালকা হাওয়াতে ঝড় আসে। ঝড় এলেই নিয়ম যায় উড়ে”
এই হালকা হাওয়াটাই হল
স্বাধীনতা,মুক্তি। মুক্তি চাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, ছুটে বেড়ানোর ইচ্ছা এসবই ভেঙে
দেয় কর্তার কর্তৃত্বকে, ভেঙে চুরমার করে দেয় ক্ষমতার দেয়ালকে। এজন্যই এই দমকা
হাওয়াকে ভয় পায় কর্তৃত্ববাদীরা, ক্ষমতাসীনরা। রবীন্দ্রনাথ রাজপুত্রকে হাজির করেছেন
মুক্তি, স্বাধীনতা হিসেবে। আর এই স্বাধীনতার হাওয়া বড়ই সংক্রামক এক হাওয়া। আরো
বেশি সংক্রামক সাহস। তাসের দেশে ভয় সংক্রমিত ছিল। সকলেই ভয়ের জন্য আটকে ছিল নিয়মের
বেড়াজালে। রাজপুত্র তাদের মাঝে স্বাধীনতা আর সাহসের সংক্রমণ ঘটায়। আর এই সাহস ভয়ের
চেয়ে দ্রুত গতিতে সংক্রমিত হয় তাসের দেশে। সাহস আর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার এই হালকা
হাওয়া ভেঙে চুরমার করে দেয় তাসের দেশের নিয়মকে। আর জয় হয় ইচ্ছের।
বাধ্যতামূলক আইন-নিষেধাজ্ঞাকে নিষিদ্ধ
করার দাবি
তাসের দেশের চমৎকার
একটা দিক হলো এটি নিষেধাজ্ঞাকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। কর্তৃত্ববাদ টিকে থাকতে
নানা রকম নিষেধাজ্ঞার জন্ম দেয়। জন্ম দেয় নানা রকম জরুরী আইনের। এই আইন কেবল
স্বাধীনতাকামীদের দমিয়ে রাখার আইন। তাসের দেশে যখন হালকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল
চারদিকে তখন গোলাম(সম্পাদক) বাধ্যতামূলক আইন চালু করার দাবি করে। এই আইন ছিল
কান-মলা আইনের নতুন নাম। কিন্তু বিদ্রোহীরা এই আইনের বিরোধিতা করে। রাণী নেতৃত্ব
দেয় সেই বিদ্রোহে। আর টেক্কারা ঘোষণা দেয় ‘অবাধ্যতামূলক বেআইনের’। রবীন্দ্রনাথের লেখার
এ অংশটুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।
স্বাধীনতার কামনা
কিংবা স্বাধীনতার কথা বহু লেখক বহু লিখাতে করে গেছেন। কিন্তু স্পষ্টভাবে
নিষেধাজ্ঞার নিষিদ্ধ করার দাবি কেউ তোলে নি। এটাই রবীন্দ্রনাথের অসাধারণত্ব।
রবীন্দ্রনাথ সমাজে/রাষ্ট্রে বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাকে প্রশ্ন করে বসেন। ‘অবাধ্যতামূলক
বেআইন’ তাই অদ্ভুত কোন জিনিস নয়। এটি নিষেধাজ্ঞাকে নিষিদ্ধ করার দাবি। নতুন নামে,
নতুন রূপে যতবার এমন দমনমূলক নিষেধাজ্ঞার কথা আসবে ততবারই তা নিষিদ্ধের দাবি ওঠে
আসবে। নিষেধাজ্ঞাকে নিষিদ্ধ করেই মুক্তিকামীরা মুক্তির পথে এগিয়ে যাবে।
বিদ্যামান সমাজ-ব্যবস্থাকে আঘাত
তাসের দেশ কেবল যে
রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে তা নয়। বরং এটি সমাজব্যবস্থাকেও প্রশ্নের
মুখে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক সত্তা অবরুদ্ধ সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়ার
প্রয়াস চালায় এ রচনাতে। একদিকে নারী-স্বাধীনতা দেখিয়েছেন নারী চরিত্রের বিদ্রোহের
মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
“তুমি কষে ধরো হাল,আমি তুলে বাঁধি পাল”
বিদ্যমান
সমাজকে-সিস্টেমকে ভাঙার জন্য তিনি এখানে সার্বজনীনতার গান গেয়েছেন। সকলে মিলে
চেষ্টা ব্যতীত সমাজের এ অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব না এটা রবীন্দ্রনাথ
অনুধাবন করতে পেরেছেন। নিয়মের বেড়াজালে অবরুদ্ধ সমাজকে তিনি ইচ্ছের শক্তি দিয়ে
মুক্ত করতে চেয়েছেন। ছক্কা আর পঞ্জা যেখানে শুরুতে নিয়মের কথা বলে বেড়িয়েছিল,
সেখানেই ইচ্ছের ডানায় চড়ে অবরুদ্ধ সমাজকে ভাঙতে চায়।
“ইচ্ছে।সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে ,সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।সেই তো আঘাত করছে তালায়,সেই তো বাধন ছিড়ে পালায়,বাধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে”
ইচ্ছের ভাঙাগড়াতে
সমাজের যে ট্যাবু সেগুলোতে আঘাত পড়ছে বারবার। আমাদের সমাজব্যবস্থার মধ্যে
রাষ্ট্রের যে শুঁড় প্রবেশ করেছে সেটা আমাদের সমাজকে ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী করে
তুলেছে। সমাজে শোষণবাদ,পরাধীনতার যে বেড়াজাল সেটি ভাঙতে হলে সমাজকে গড়তে হবে
নতুনভাবে। আর সেই গড়াটা হতে হবে ভালোবাসা আর সম্প্রীতির ভিত্তিতে।
ইচ্ছে বনাম নিয়ম
ইচ্ছে বনাম নিয়মের যে
বাইনারি সেটা মূলত স্বাধীনতা আর শৃঙ্খলার বাইনারি। শৃঙখলমুক্ততাই প্রকৃতির স্বাভাবিকতা।
আর নিয়ম হলো স্বাধীন জীবনের বাধা। তাসের দেশ আমাদের মুক্ত ,স্বাধীন জীবনের এক গল্প
বলে। মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত প্রকৃতিকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেয়, যে সাজিয়ে নেয়া কখনো
প্রকৃতির জন্য মঙ্গলজনক হয় কখনো বা হয়ে ওঠে বিপদজনক। সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন
মানুষকে অবরুদ্ধ করে ফেলে তখন মানুষের জীবন হয়ে যায় খাঁচাবন্দী। এই খাঁচাবন্দী
জীবনে মানুষ বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না তার স্বভাবজাত প্রবৃত্তির জন্যই। মানুষের
স্বাধীনতার কোনো সীমা নাই। সীমা নির্ধারণ করা উচিতও নয়। শৃঙ্খলা সর্বোচ্চ
খাচাবন্দী এমন এক জীবন দিতে পারে যেখানে দানাপানির কোনো চিন্তা থাকে না। কিন্তু
পেটের ক্ষিধার বাইরেও মানুষের মনের ক্ষিধা থাকে । এই মনের ক্ষিধা হলো স্বাধীনতা
,সে স্বাধীনতা হলো গান গাইবার স্বাধীনতা, মুক্তভাবে কথা বলার স্বাধীনতা ।
ইচ্ছের ডানা যত বড়
হতে থাকবে নিয়মের বেড়াজাল থেকে আমরা ততই মুক্ত হতে পারব। ইচ্ছে আমাদের সেই
কাঙ্ক্ষিত মুক্ত সমাজের দিকে নিয়ে যাবে যে সমাজে কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না, যে সমাজে
কোনো শোষণ থাকবে না, যে সমাজে কোনো একঘেয়েমি থাকবে না। আমাদের এই মুক্ত সমাজের
ভিত্তি হবে ভালোবাসা আর পারস্পরিক সৌহার্দ্য। নিয়ম যতবার আমাদের এই মুক্ত জীবনের
পথে বাধা হয়ে আসবে ততবারই ইচ্ছেই আমাদের বাঁচাবে।
নতুন যৌবন-নতুন সমাজ
তাসের দেশের অন্যতম
একটা গান হলো নতুন যৌবনেরই দূত।
“আমরা নতুন যৌবনেরই দূত।আমরা চঞ্চল ,আমরা অদ্ভুত।আমরা বেড়া ভাঙি,আমরা অশোকবনের রাঙা নেশায় রাঙি,ঝঞ্ঝার বন্ধন ছিন্ন করে দিই –আমরা বিদ্যুৎ।। ”
এই নতুন সমাজ গড়ার
আহবান রবীন্দ্রনাথ বারবার করেছেন যুবকদের কাছে। বারবার তিনি ফিরে গেছেন তরুণদের
কাছে। মুক্তিপরায়ণ যে সমাজ তার রূপকল্প রবীন্দ্রনাথ বহু জায়গাতেই দিয়ে গেছেন। সে
সমাজে তিনি কোনো বাধা চান না। চান না কোনো অজানার ভয়। ভয়কে জয় করেই এগিয়ে যাবে
তরুণ-যুবকরা। এটাই রবীন্দ্রনাথ বারবার আশা করেছেন। তাসের দেশে তাই তো সকলে মিলে
গাইল বাঁধ ভাঙার গান,
“ বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও,বাঁধ ভেঙে দাও।বন্দী প্রাণমন হোক উধাও।শুকনো গাঙে আসুকজীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক;ভাঙনের জয়গান গাও।জীর্ণ পুরাতন ভেসে যাক,যাক ভেসে যাক,যাক ভেসে যাক।আমরা শুনেছি ঐমাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃকোন নূতনেরি ডাক।ভয় করিন না অজানারেরুদ্ধ তাহারি দ্বারেদুর্দান্ত বেগে ধাও।। ”
Comments
Post a Comment